বাঘের মুখ, যমের দ্বার

October 11, 2023

[এ. কে. এম হাসানের “ইন দ্য জাজ অফ এ টাইগার” অবলম্বনে]

লূ-টা ছুটে আসছে সোজা যেন সূর্যপিণ্ডের চুল্লী থেকে। গাছপালা ঝলসে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে জীবজন্তুর। কোহিরা নদীর বুকে ধুধু বালি, তবে অবশ্য দুই একটা ছোট-বড় ডোবা আছে অগভীর জলের, কোনটা মানুষের হাতে খোঁড়া, আবার কোনটা হয়ত হাতীরাই খুড়ে রেখেছে দাঁতের সাহায্যে, সারাদিন রোদে পড়ে সন্ধ্যার দিকে তপ্ত দেহে শুঁড় দিয়ে জল ছিটোতে না পারলে কোনমতেই চলে না ওদের ৷

বিন্ধ্য গিরিমালারই একটা শাখা এই কাইমার পাহাড়, সেই পাহাড়েই এক গভীর উপত্যকা দিয়ে বইছে কোহিরা নদী, কাওয়া-খো এই উপত্যকার নাম। এর রাজা হচ্ছেন এক পেল্লায় বাঘ। বনের পশরা আর গাঁয়ের রাখালেরা, কারা ও’কে শাপমন্যি বেশী দেয়, তা বলা শক্ত।

রাজা-বাঘ এই সবে প্রাতরাশ শেষ করেছেন। একটা ধাড়ী মোষ মেরেছিলেন আগের দিন। তার সিকিটা উদরস্থ হয়েছে কালই, আরও সিকি পরিমাণ সেবায় লাগল এইমাত্র। রইল বাকী এখনও আদ্ধেকখানা ধড়। তা থাকুক। সন্ধ্যাবেলার ব্যবস্থা হয়ে রইল, কাল সকালেরও। তবে আজ রাতের মধ্যে যদি শেয়ালে-টেয়ালে

এসে প্রসাদ পেতে চায় রাজার, পাক গে যাক। সম্মুখে একটা আস্ত রাত পাবেন রাজা, নতুন একটা কিছ, শিকার কি আর তার মধ্যে পারবেন না জুটিয়ে নিতে?

খাওয়া শেষ, এইবারে চাই জল। কোহিরার দুই একটা ডোবায় যে নির্মল জলই জমে আছে, তা খবর রাখেন রাজা। সেই দিকেই তিনি মৃদু মন্থর পা চালিয়ে দিলেন।

ঐ যে ডোবাটা!

আর ঐ যে তার অল্প দূরেই মাচানের উপরে এক জোড়া মানুষ, স্থানীয় শিকারী তাজ, শেখ আর স্থানীয় চৌকিদার বালা দোসাদ। তাজর হাতে একটা বন্দুক।

রাজা-বাঘ চলে আসছে জলের দিকে, লেঙ্গুরেরা চ্যাঁচাচ্ছে, ময়ুরেরা ডানা ঝাপটাচ্ছে। সেই শোরগোল শুনেই মানুষ দুটো তাকাল ওদিক পানে। ঐ ত বাঘ ! দোসাদ বলছে শেখের কানে কানে— “জল খেয়ে যদি স্বচ্ছন্দে উঠে আসে ও, এ-ডোবার ধারে কাছেও আসবে না আর। হুঁশিয়ার জানোয়ার তো! চামড়াখানা যদি বাগাতে চাও, এক্ষুণি গুলি কর।”

এ-বাঘটার চামড়াখানা বাস্তবিক লোভের জিনিস শিকারীর কাছে। হলদে চামড়ায় কালো কালো ডোরা। খর-রোদে ঝলকাচ্ছে সমস্ত দেহটা। ও-চামড়া বাজারে বেচে দিলেও ঢের দাম, আবার বৈঠকখানায় ফরাসে পেতে রাখলেও বাহারের চূড়ান্ত।

কিন্তু চামড়ার উপর লোভ যতই থাকুক, এই মুহুর্তে গুলি চালাবার উপায় নেই তাজের। তার বন্দুকের লাইসেন্স ফুরিয়েছে। নতুন করে লাইসেন্স পাওয়ার অগে সে যদি গুলি করে বসে বাঘকে, সেটা হবে অপরাধ। তার ফলে তাজের বন্দুকটাই সরকার বাজেয়াপ্ত করে নিতে পারেন। অমন হঠকারিতা কি সে করতে পারে? তা চামড়াখানা যতই লোভনীয় হোক?

না, তা সে পারে না। বুদ্ধিমান লোক সে। বাঘে মোষ মেরেছে শুনেই সে এস-ডি-ও গর্ডন সাহেবকে খবর পাঠিয়েছে, এদিকে মাচান-টাচান বেঁধেও রেখেছে সাহেবের আসার আশায়। গর্ডন নিজে পাকা শিকারী, খবর পেলেই যে ছুটে আসবেন কাওয়া-খো উপত্যকায়, তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। আসবেন, বাঘ মারবেন, এবং তাজ, শেখের আইন-নিষ্ঠার পুরস্কার বাবদ এইখানে দাঁড়িয়েই নতুন লাইসেন্স মন্জুর করে দেবেন তার, এই রকমই মনে মনে আশা তার।

কানে কানে সেও বালা দোসাদকে বোঝাতে চাইছে যে কী কারণে নিজে সে আজ অত মূল্যবান ব্যাঘ্রচর্ম খানি সংগ্রহ করবার জন্য উদ্যোগী হতে পারছে না।

লাইসেন্স-সমস্যার ব্যাপারটা বালা দোসাদের না বুঝবার কথা নয়, সে যখন নিজেই সরকারী লোক। চার বৎসর অন্তর নীল কাপড়ের একটা পাগড়ি পায় মহামহিম সরকারের কাছ থেকে, এবং মাঠে লাঙ্গল ঠেলবার সময়ও সে-পাগড়ি মাথা থেকে নামায় না। সরকারী লোক সে, আইনের মান সে না রাখলে কে রাখবে?

কিন্তু বাঘটা ?

বাঘটা যদি একবার ঐ ডোবায় নেমে পিপাসা মেটাতে পারে, হয়ত সে আজকের দিনের মধ্যেই আর আসবে না জলের কাছে। এখানে এই মাচান-টাচান বৃথা হবে। এদিকে গর্ডন সাহেবের কাছে খবর চলে গিয়েছে, তিনি নিশ্চয়ই আসবেন। এসে যদি তিনি দেখেন যে বাঘ উধাও হয়ে গিয়েছে তল্লাট থেকে, তিনি তাজর বন্দুক  হয়ত তাজর মাথাতেই ভাঙ্গবেন। উপায় কী তাহলে?

উপায়, জানোয়ারটাকে জল খেতে না-দেওয়া। রোদের তাপ যেমন প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ডতর হচ্ছে প্রতি মূহুর্তে, তাতে জল না-খাওয়া পর্যন্ত জলের সান্নিধ্য ছেড়ে যেতে পারবে না জানোয়ারটা। ও অপেক্ষা করুক, ঘোরাঘুরি করতে থাকুক, ততক্ষণে এসে পড়ুক গর্ডন।

যদি কাজ হয় ত এই ফন্দীতেই হবে।

মাচানে উঠবার আগে একখানা কুড়োল হাতে নিয়ে উঠেছিল দোসাদ। তারই মাথাটা দিয়ে সে এইবার গোটা দুই ঘা দিল গাছের গাড়িতে। চলতে চলতে বাঘ শুনতে পেলো সে-আওয়াজ, আর চারদিকে তাকাতে লাগল সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে। সে- দৃষ্টি অবশেষে নিবদ্ধ হল মাচানের উপরে। নিবদ্ধ হল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। মানুষ ? মানুষ নাকি ঐ গাছটাতে? না-থাকলে ওর ডালে ওরকম অস্বাভাবিক ঝোপঝাড় কেন খানিকটা? নাঃ, জল খাওয়া মাথায় থাকুক এখনকার মত—

বাঘের দেহটা মোড় খেয়ে গেল চকিতে, এক লাফে সে ডাইনের জঙ্গলে অদৃশ্য হল। মাচানের উলটো দিকে।

তারপর শুরু হল ধৈর্যের প্রতিযোগিতা।

তাজ, আর দোসাদ বসে আছে মাচানে—কখন আসে গর্ডন, কখন আসে গর্ডন। আর রোদ-চোয়ানো হলদে-কালো চামড়া গায়ে চড়িয়ে রাজা-বাঘ বসে আছে নিবিড় ঝোপে, কখন মাচান থেকে নেমে যাবে অদৃশ্য দোপেয়ে দুশমনগুলো, সে নিরাপদে গিয়ে চোঁ চোঁ করে খেয়ে আসবে এক কলসী জল।

নাঃ, গর্ডন আসছেন না। কী করে আসবেন এত তাড়াতাড়ি। বেলা নয়টা। এই ত তাঁর এজলাসে বসবার সময়। বিহারের আগুন-ঝরা রোদে পরে কোর্ট কাছারি করা সম্ভব হয় না, এজলাসের কাজ হাকিমেরা সকালেই সমাধা করেন।

গর্ডন আসছেন না, কাজেই তাজ আর বালা দোসাদ নামতে পারছে না মাচান থেকে। ধৈর্যং রহ! ধৈর্যং রহ। মনকে বোঝাচ্ছে তারা।

কিন্তু রাজা-বাঘ আর পারছে না। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। হয় গুলি খেয়ে মরতে হবে, নয় ত জল না খেয়ে মরতে হবে। তার উপরেও আর এক কথা, শিকারী গুলি করলেই যে বাঘ মরবেই মরবে, এমন কোন কথা নেই। কিন্তু এই গরমে, ভরপেট কাঁচা মাংস গেলার পরে চার ঘণ্টা যদি জল খেতে না পায় কোন বাঘ, সে যে মরবে, তা প্রত্যেক বাঘই জানে।

যায় প্রাণ, জল খেতে গিয়েই যাক। রাজা-বাঘ গা তুলল। একটু একটু করে, মাটিতে শুয়ে শুয়ে, ঝাঁকে সরে সরে নিঃশব্দে এগুতে লাগল সে। মাচান থেকে তাজ, আর বালা দেখছে, ঝোপে ঝাড়ে একটা নিরবচ্ছিন্ন জঙ্গল ডাইনে বাঁয়ে সর্বত্র। কিন্তু সেই জঙ্গলের মাঝে চলতে চলতে রাজা-বাঘ দেখছে যে সে-জঙ্গলে ছেদ আছে মাঝে মাঝে, পাঁচ হাত দশ হাত করে ফাঁকা মাটি এক এক টুকরো। সেই ফাঁকা মাটি গুলোই বাঘের পক্ষে বিশেষ ভয়ের জায়গা। সে ত জানছে না যে মাচানের দুশমনগুলোর চোখে সে-সব ফাঁকা ধরা পড়বারই উপায় নেই। মরি-বাঁচি করে, জানটি হাতে করে রাজা-বাঘ সাঁতরে পেরচ্ছে সে-সব জায়গা। এক একটা পেরচ্ছে, আর সমমুখের ঝোপটাতে ঢাকে হাঁপাচ্ছে দুই চার মিনিট করে। ছাতি-ফাটা তেষ্টা নিয়ে এ-রকম সার্কাসী কসরত দেখানো কি সোজা নাকি ?

বাঘ এই রকম ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগচ্ছে, ওদিকে মাচায় বসে তাজ, আর বালা তাকিয়ে আছে দূরের মাঠে ভইসদের পায়ে-পায়ে-পয়দা পথরেখাটার দিকে। সহসা বালা দোসাদ লোকটা লাফিয়েই উঠতে যাচ্ছিল, আহ্লাদে আটখানা হয়ে, তাজ, শেখ চেপে ধরে বসিয়ে রাখল তাকে। হয়েছে, দীর্ঘ প্রতীক্ষা ফলবতী হয়েছে তাদের। শোলার টুপি থেকে মালাম, গর্ডন সাহেব এসে গিয়েছেন, একটা শিকারী সঙ্গে নিয়ে। গ্রাম পর্যন্ত গাড়িতেই এসেছিলেন, তারপর পায়দল ছাড়া উপায় কী আর? এজলাস আজ সকাল সকাল ভেঙ্গে দিয়ে এসেছেন সাহেব। বাঘ যে! সব রাজকার্যের সেরা কাজ হল বাঘ মারা। তাকে মারতে যত দেরি হবে, ব্রিটিশরাজের তত বেশীই মারা পড়বে ভক্ত প্রজা।

শিকারী যাকে সঙ্গে এনেছেন সাহেব, সে আসলে কোন অর্থেই শিকারী নয় পথঘাট চেনে এই পাহাড় জঙ্গলের, মাচানটা কোথায় বাঁধা হয়েছে, তাও জানে। “মাচানে তাজ, শেখ আছেন, বালা চৌকিদারও আছে।” সে সবিনয়ে নিবেদন করল, ঝোপ- ঝাড়ের এলেকায় প্রবেশ করবার আগেই। এ নিবেদনের তাৎপর্য হল এই যে সে আর অগ্রসর হতে ইচ্ছুক নয় বাঘ-রাজার রাজ্যসীমার দিকে। সাহেবও মাচান দেখতে পেয়েছেন। হাতের ইশারাতেই তাকে বিদায় দিয়ে দিলেন তৎক্ষণাৎ। আনন্দের আতিশয্যে শিকারীটা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা এস-ডি-ও-কে সেলাম করতেও ভুলে গেল।

সাহেব এসে উঠলেন মাচানে।

এইবার বালা দোসাদের পালা। “হুজরের যদি হকুম হয়, আমি দুখানা রোটি চিবিয়ে আসি গাঁও থেকে। যাব আর আসব।”

তাজ, শেখ তার দিকে তাকালেন যে-দৃষ্টিতে, তার আগুনে ভস্ম হয়ে যাওয়ার কথা দোসাদের। তা যে সে গেল না, এই কারণে যে কালটা ঘোর কলি । এযাগে ব্রহ্মতেজে কেউ ভস্ম হয় না, আর তাজ, আবার জাত্যংশে ব্রাহ্মণও নন, বরং ঠিক তার উলটোটা।

গর্ডন ওদিকে আর একবার হাত নেড়ে দিয়েছেন নিঃশব্দে, অর্থাৎ যেতে পারে বালা দোসাদ লাঞ্চের চেষ্টায়। বালা আর দেরি করে?

তা বলে বাড়ি গিয়ে রোটি খাওয়ার কোন বাসনাই তার নেই এখন। সে চাইছে নিরাপদ দূরত্ব থেকে বাঘে মানুষে আসন্ন লড়াইটা স্বচক্ষে দেখতে। বুড়ো বয়সে নাতি-নাতনীদের শোনাবার মত একটা গল্পের উপকরণ সংগ্রহ করে রাখতে। খোলা মাঠে না গিয়ে সে নদীটা পেরলো। অবশ্য সাহেবের আর তাজেরর নজরের আড়ালে গিয়ে। তারপর ঘরে এসে মাচানের প্রায় সামনা-সামনি একটা বড় গাছের উঁচু তেডালায় আরাম করে বসল, ওপারের লড়াই দেখবার জন্য। জায়গাটা পেয়েছে সে জাত-মাফিক। সে দেখতে পাবে সাহেবকে, তাজকে, বাঘকে। অথচ উলটে তারাও যে দেখতে পাবে দোসাদকে, তার উপায় নেই। একটা ঝাড়ালো ডাল তাকে আড়াল করে রেখেছে। যা বাবা! লেগে যা তোরা এইবার!

রাজা-বাঘ তার দূরূহ পরিক্রমা শেষ করেছে শেষ পর্যন্ত, দাঁড়িয়েছে ঠিক কোহিরার খাড়া পাড়ের মাথায়। পায়ের নীচেই জলে-ভরা ডোবা, ঝাঁপ দিয়ে পড়লেই হল। ঝাঁপ দেবেও রাজা! এক্ষুণি দেবে! তবে তার আগে একবার দেখে নিচ্ছে চারি ধারটা। ডাইনে তাকাচ্ছে, বাঁয়ে তাকাচ্ছে, মাথা তুলে মাচানের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিপাত করছে বারবার। নাঃ, ভয় তার যাচ্ছে না। আছে! প্রাণঘাতী শত্রু, নিকটেই আছে বলে বিশ্বাস তার। কিন্তু উপায় কী? জল ত না-খেলেই নয়। ঘণ্টা চারেক ধরে সে সহ্য করে আসছে, অসহ্য পিপাসার কষ্ট। আর তো পারে না সে। আর তো পারে না। যা থাকে কপালে, তাই হবে—এই ভেবে সে দিল লাফ, পড়ল জলে। মাথা নামিয়ে দিল জলের দিকে। আঃ! জল! জলই ত জীবন!

গর্ডন দৃষ্টি রেখেছেন মাচানের ভিতর থেকে। রাজা-বাঘ মাথা নীচু করে জল খাচ্ছে। গর্ডনের রাইফেলের নলের ঠিক সম্মুখে পড়েছে তার পাঁজরা। ৩০ স্প্রিং ফিল্ড রাইফেলটা গর্ডন ঠিক কাঁধের উপরেই রেখেছেন কিছুক্ষণ থেকে। এইবার টিপে দিলেন তার ঘোড়া ।

রাজা-বাঘ সঙ্গে সঙ্গে উলটে পড়ল জলের ভিতর, ডিগবাজিই খেলো যেন একটা। চার পা শূন্যে উঠে গেল তার। সেই চার পা কয়েকবারই এলোমেলো এদিক ওদিক ছাড়ল রাজা। তাজ ওদিকে ফিসফিস করছে অধীর উত্তেজনায়—“হুজুর ! আর আর একটা!” একটা !

“আরে, তুমি বল কী শেখ ?”- তর্জন করে উঠলেন সাহেব -“একটা ফুটো হয়েছে চামড়াখানায়। আরও একটা যদি হয়, ওর আর কোন বাহার থাকবে নাকি?”

গর্ডনের রাইফেলের নলের ঠিক সম্মুখে পড়েছে। আর এদিকে কিন্তু কথায় বলে—বেড়ালের জান থাকে নয়টা। তা লোকপ্রবাদে ত শোনা যায় বাঘেরা বেড়ালেরই বৃহৎ সংস্করণের বোনপো। সেই সুবাদে বাঘের জান নয়-নং একাশিটা তো অন্ততঃ হতেই পারে! না যদি হয়, তবে ও বাঘ জল থেকে উঠে জঙ্গলে আশ্রয় নেবার মত জান পায় কোথায় ?

ঠাণ্ডা জলে চুবনি খেয়ে গা-গতোর এবং মাথা সবই তখন ঠাণ্ডা রাজার। আর একটা পালটা-ডিগবাজি সে খেলো। হাওয়া আঁচড়াচ্ছিল যে চার পা, তারা আবার স্বস্থানে ফিরে গেল পেটের নীচে। এক লাফে সে উঠে পড়ল পাড়ে। এইবার আর এক লাফে সে এক্ষুণি অদৃশ্য হয়ে যাবে জঙ্গলে —

আর ত চামড়ার বাহারের কথা ভাবলে চলে না! গর্ডন দ্বিতীয় গুলি ভরতে গেলেন রাইফেলে। হায় রে বরাত! ঠিক এই সময়েই কলকবজা বিগড়ে বসে রইল? তাড়াতাড়ি করতে গেলে কোন কাজই তাড়াতাড়ি হয় না। গুলি-করাও হল না গর্ডনের। তাজ, শেখের হাতে বন্দুকে ত গোড়া থেকেই আছে। সাহেব যখন সম্মুখেই আছেন, তখন অবস্থা বিচারে বিনা লাইসেন্সে গুলি চালানোর কসরে তিনি হয়ত ক্ষমাও করতে পারেন, এই আশায় সে চালিয়ে দিল গুলি। কিন্তু বাঘ তখন বায়ুবেগে  ছুটেছে, ছুটন্ত বাঘকে ঘায়েল করার মত অব্যর্থ লক্ষ্য তাজ, শেখের নয়। সে গুলি ফসকে গেল। বাঘ গিয়ে ঢুকল জঙ্গলে। বন-বাদাড় মড়মড় করে ভেঙ্গে পড়ছে তার দেহের ধাক্কায়, শ’-খানিক গজ দূরেও তার আওয়াজ পাচ্ছেন গর্ডন সাহেব মাচানে বসে।

মাচান থেকে তিনি নামলেন কয়েক মিনিট পরে। “রোটি চিবিয়ে” বালা দোসাদ তখন ওপার থেকে এপারে এসে পড়েছে, জোড়া জোড়া গুলির আওয়াজ শানে গাঁয়ের লোকও এসে জুটেছে দলে দলে। বাঘ যখন জখম হয়েছে, তখন রক্তের দাগ থাকবেই মাটিতে। তা দেখে দেখে ওকে অনুসরণ করাতে বাধা কী আছে? আগে আগে গর্ডন, পিছনে একটা পাঁচমিশেলী জনতা, প্রায় মাইল খানিক ঢুকে পড়ল অরণ্যের সেই অন্দরে। সম্মুখে একটা নালা পড়ল এবার। সেখানে যেমন চ্যাঁচাচ্ছে লোকেরা, তেমনি চ্যাঁচাচ্ছে ময়ুরেরা। অর্থাৎ বাঘ ঘাপটি মেরে আছে ঐ নালাতেই। বেলা এখন চারটে। নালার ভিতরে হয়ত ছায়া পড়ে এসেছে এতক্ষণে। আবছা আঁধারে আহত বাঘকে পায়দলে তাড়া করতে যাওয়া দু:সাহসের কাজ হবে বলেই মনে হল সাহেবের।

প্রথম পর্ব শেষ হল এই নব কুরুক্ষেত্রের। চক্রব্যূহে আবদ্ধ হয়েও অভিমন্যু সগৌরবে তা থেকে নিষ্ক্রান্ত হল, সামান্য একটা আঘাত নিয়ে ।

এখন? পরবর্তী কার্যক্রম কী?

গর্ডন সাহেব গ্রামে ফিরে এসে স্থানীয় শিকারীদের তলব করলেন। কোহিরার শুকনো ঢুকে যে কয়টা ডোবা আছে, ছোট হোক আর বড় হোক, প্রত্যেকটার নিকটে একটা করে মাচান তৈরি করে ফেললো তারা। গর্ডন রয়েই গেলেন গ্রামে। তাজ, শেখ ভেট পাঠাল দুটো তাজা মোরগ আর দুই ডজন টাটকা আণ্ডা। তার লাইসেন্স সে এখনো পায় নি।

পরদিন সন্ধ্যার আগেই। সবচেয়ে বড় যে ডোবাটা, তারই নিকটে গিয়ে মাচানে অধিষ্ঠান করলেন গর্ডন। অন্য সব মাচানেও বন্দুকধারী শিকারী আছে। তাজ, এবং তার সমগোত্রীয়।

সারা রাত চোখের পাতা বুজতে পারে নি কেউ। সকালে সবাই এসে জড়ো হল এক জায়গায়। কেউ কোন সাড়া পায় নি আহত বাঘের। অতঃপর সবাই মিলে বেরলো, ডোবাগুলোর আশপাশ পরীক্ষা করবার জন্য। নরম মাটিতে কোথাও বাঘের থাবার দাগ আছে কিনা, সেইটাই দ্রষ্টব্য।

আছে। গর্ডন যে-মাচানে রাত কাটিয়েছিলেন, তারই নিকটে আছে। মাচানের ত্রিশ ফুটের মধ্যে৷ সেই পর্যন্ত এসে, তারপর রাজা-বাঘ মোড় নিয়েছে একটা, জল খেয়েছে গিয়ে অদুরবর্তী একটা ছোট গর্তে। এত কম জল সেখানে, আর সে-জল এত ঘোলা, কোন মর্যাদাবান শার্দুল যে সেখানে জল খেতে রাজী হতে পারে, একথা ভাবে নি শিকারীরা, আর ভাবে নি বলেই সেখানে মাচানও বানায় নি।

ত্রিশ ফুট নিকটে এসে বাঘ চলে গেল অন্য দিকে। কবির ভাষায়—“ধরা দিয়ে পলাইল সফল স্বপন”। হয়ত গর্ডন সাহেব চুরুট টানছিলেন সেই সময়টায়। চুরুটের আগুনে হয়ত দেখে থাকবে বাঘ, বা গন্ধ পেয়ে থাকবে তামাকের। গায়ের চামড়াটা সাহেবকে নজর দেওয়া তার মনঃপূত নয় বলেই মোড় ঘরে নোংরা জলের গর্তের দিকে চলে গিয়েছে সে। কী আর করবে? আপধর্মে বিশ্বামিত্র (রাজা ও ঋষি) কুকুরের মাংস খেয়েছিলেন যে!

গর্ডনের আর বসে থাকা চলে না এই সিসি গ্রামে। তাঁর ত কাজকর্ম আছে! ভয়া রওনা হয়ে গেলেন তিনি। “বাঘের সাড়া পেলেই খবর দেবে আমায়”—বলে গেলেন গ্রামবাসীদের।

সাড়া নয়, চিহ্ন পেলো বালা দোসাদ। সে দেখল, কোহিরার বুকে বালির উপরে লুটোপাটি করেছে বাঘটা। ঘা তার বিষিয়ে উঠেছে নিশ্চয়। পুঁজ পড়েছে অজস্র তা থেকে। বালির সঙ্গে মিশেছে পুঁজ, তৈরী হয়েছে ঘাটের আকারের এক একটা বালির চাপড়া। সাধারণতঃ বাঘের গায়ের ঘা বিষিয়ে উঠতে পারে না এরকম। জিভের লালা এমনিই ওষুধ ওদের, ঘা যদি মাঝে মাঝে চাটতে পারে ওরা, তাহলে সে-ঘা বিষিয়ে যাবার কোন ভয় থাকে না আর। এক্ষেত্রে বাঘটা চাটতে পারে নি ঘা। তার মানে এই যে সে ঘা হয়েছে তার ঘাড়ে। গর্ডন তাক করেছিলেন পাঁজরায়,  ‍গুলি লেগেছে পাঁজরা থেকে ছয় ইঞ্চি আন্দাজ উপরে।

গোয়ো শিকারী ভোলাইনারাপই নিলে বাহাদুরিটা। বাঘকে সে আবিষ্কার করল এক গুহার মধ্যে। কার্টারর জঙ্গলে। যেখানে গর্ডন গুলি করে- ছিলেন তাকে, সেখান থেকে মাত্র মাইল খানিক দূরে। দূরে তো যাওয়া মুশকিল! জল তো কোহিরার বালির নীচে ছাড়া অন্য কুত্রাপি নেই এ তল্লাটে!

বাঘের পাত্তা মিলেছে, খবরটা সঙ্গে সঙ্গে পাঠানো হল গর্ডনকে। হাকিমির হাজার কাজ শিকেয় তুলে রেখে তিনি আবার চলে এলেন সিসিতে। রাজা- বাঘের সঙ্গে প্রথম মালাকাত যে-রাতে হয়েছিল তাঁর, তা থেকে ঠিক আট দিন পরে।

শুরু হল মহাযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব ।

তৈরী হয়েছে ঘটের আকারের এক একটা বালির চাপড়া।

গর্ডন যখন ভোলাইনারাণের সঙ্গে বাঘ দেখতে বেরুলেন, বেলা তখন এগারোটা। দলে আছেন সাহেব নিজে, ভোলাই আর অন্য দুটি গোয়ো শিকারী। তার মধ্যে বন্দুকধারী মাত্র একটিই, নাম তাঁর রামচন্দ্র রায়। ভোলাই আগে আগে, সে দেখিয়ে দিল বাঘ দাঁড়িয়ে আছে ঠিক গুহা মুখেই, আবছা আঁধারে হলদে কালো একটা পাথরের চাঙ্গড় যেন। সাহেব আছেন ভোলাইয়ের পিছনে। জায়গা এমন প্রশস্ত নয় যে ভোলাই সরে দাঁড়াবে ডাইনে বা বাঁয়ে, সাহেবকে ভাল করে দেখার সুযোগ দেবার জন্য। সাহেব এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন তাঁর পাশেই একটা গাছ রয়েছে সুবিধামত। তিনি সেইটিতে উঠবার উপক্রম করলেন। বাঘ এদিকে একটু খানি সতর্ক হতে শিখেছে, আট দিন আগের সেই নিদারণ অভিজ্ঞতার পরে। গায়ে-পড়া হয়ে আক্রমণ করতে যাওয়ার উৎসাহ তার আপাততঃ নেই। কাঁধের ঘা দিয়ে পুঁজ গড়াচ্ছে এখনও। এত-এত দুশমন সম্মুখে দেখে রাজা-বাঘ তাঁর দূর্গের মধ্যে অপসৃত হলেন, অর্থাৎ ঢুকে পড়লেন গুহার সবচেয়ে আঁধার কোণটিতে। আসুক না, কে আসবে এখানে সাহস করে। তার ঘাড় তো আগে মটকাবেই রাজা! তার পরে নিজের ভাগ্যে যাই হোক।

সাহেবের দেখাদেখি অন্য সবাইও ততক্ষণে গাছে গাছে চড়ে বসেছে। ‘চাচা আপনা বাঁচা’ নীতির অনুসরণে। বাঘও নিজের কেল্লায় অবস্থান করছে সঙ্গোপনে। এভাবে কতক্ষণ চুপ করে থাকা যায়? গর্ডন গুলি চালিয়ে দিলেন গুহার আঁধারের ভিতরে। কোন কিছুকেই লক্ষ্য না করে। নজর চলে না যেখানে, সেখানে তাক করার কথাই ত উঠতে পারে না।

গুলি গিয়ে লাগল এক চাড় পাথরে। ঠিকরে এসে উলটে বাইরেই পড়ল গুহার। ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিতে মিলে তুলকালাম শোরগোল। বাঘ ভয় পেয়ে গেল, গুহাটা ধসে পড়বে নাকি তার মাথার উপরে? ওরে বাপ! তাহলে আর এখানে থাকা নয়। সে ছুটে বেরলো। তাঁর বেগেই বেরুলো। একটা বিদ্যুৎেশিখার মতই গর্ডনের সমুখে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল, তিনি এর জন্য তৈরি ছিলেন না। গুলি-চালানোর কথা ভাববার আগেই দেখলেন, বাঘ ঐ অদৃশ্য হয়ে যায় ডাইনের জঙ্গলে।

সাহেব যখন গুহার ভিতর গুলি চালালেন, রামচন্দ্র রায় তখন থেকে উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন নিজের বাহাদুরি জাহির করবার জন্য। এইবার দেখলেন বাঘ পালায় ঐ। এও দেখলেন যে সাহেব নিশ্চেষ্ট। তা হলে এই ত তাঁর মওকা। বন্দুকে ঘাড়ে তুলে তিনি মেরে দিলেন এক গুলি। তাক করার কোন সময়ই বস্তুতঃ পান নি, তবে, গুলিটা লাগল। লাগল গিয়ে বাঘের পিছনের পায়ে। তাতে তার গতিরোধ হল না। রক্তের ছড়া দিতে দিতে সে ঝোপঝাড়ের রাজ্যে উধাও হয়ে গেল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার গর্জন শোনা যেতে থাকল দূর-দূরান্তরের অরণ্য থেকে।

ওখানে ওকে তাড়া করতে যাওয়া চরম গোঁয়ার্তুমি হবে। গর্ডন তেমন কাজ কখনো করবেন না। শিকারীর আর সেনাপতির জেদী হওয়া চলে না। দরকার বুঝলে তাকে তক্ষুণি পিছিয়ে আসতে হবে। আজ যে বেঁচে রইল, কাল সে আবার লড়বার সুযোগ পাবে। আজ যে মরে গেল, তার আর সে-যোগ আসবে না কোনদিন।

“চল, খাওয়া দাওয়া সেরে আসি” — সাথীদের বললেন গর্ডন। সবাই বেরুলো খাদ থেকে, ফিরে এল গ্রামে। সবে খেতে বসেছে সবাই, এক শিকারী, এ জঙ্গলেই বসে ছিল গাছে চড়ে, দৌড়ে এসে খবর দিল—দেখা দিয়েছে দুশমন বাঘ।

খাওয়া মাথায় উঠে গেল। রুমালে মুখে মুছে গর্ডন জলের দিকে ছুটলেন আবার। বাঘ একটা নালার ভিতর বসে আছে ওত পেতে, মুহূর্তের নোটিশে লাফ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে। নালার মুখেটা আধাআধি আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত এক চাড় পাথর। সাহেব ভাবলেন, ঐ চাঙ্গড়টার মাথায় উঠে দাঁড়াতে পারলে বাঘকে তিনি ভাল করে লক্ষ্য করতে পারবেন।

অতি ধীরে, অতি ধীরে, নিঃশব্দে তিনি উঠছেন চাড়টার গা বেয়ে। নিঃশব্দে, যাতে বাঘ বুঝতে না পারে যে তিনি এগুচ্ছেন তার দিকে। নির্বিঘ্নেই এক সময় গর্ডন উঠে দাঁড়ালেন চাঙ্গড়টার মাথায়, ঠায় দাঁড়িয়েও রইলেন কিছুক্ষণ, দম নেবার জন্য, তারপর তৈরী হলেন গুলি চালাবার জন্য।

কিন্তু রাজা-বাঘ কি তাঁর এসব তোড়জোড় কিছুই টের পায় নি? চাড়ের মাথায় তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন কেবল, ভীম গর্জনে পাহাড় কাঁপিয়ে দিয়ে মহাব্যাঘ্র ধেয়ে এল তাঁর দিকে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের মত। দু’জনের মধ্যে ব্যবধান পঞ্চাশ ফুটের বেশী নয়। কয়েকটা মাত্র লাফেই তা অতিক্রম করে এসে চাড়ের গা বেয়ে উঠতে লাগল রাজা। গর্ডন দাঁড়িয়ে আছেন শিলাস্তুপটার মতই অটল নিষ্কম্প, রাইফেল তৈরী তাঁর হাতে, মুখোমুখী গুলি চালাবেন একেবারে ওর হৃদয় লক্ষ্য করে।

কী ধূর্ত! কী ধূর্ত এই বনের রাজা!

গর্ডন দাঁড়িয়ে আছেন মুখোমুখী গুলি চালাবার আশায়, বাঘটা কি এতই বোকা যে সে তাঁকে সেই সুযোগ দেবে? তাতে যে এক গুলিতেই তার খতম হওয়া অনিবার্য তা কি আর জানে না সে! এই গর্জন, এই ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসা, সবই তার অভিনয় শুধু! ধোঁকা দেওয়ার জন্য শিকারীদের। মাত্র যখন কুড়ি ফুটে বাকী আছে দূরত্বটুকুর, তখন বোঝা গেল তার আসল মতলব। দৌড়ের মুখেই সে মোড় ঘুরে দিল এক লাফ ডাইনের দিকে, আর পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলে-ঢাকা এক গভীর নালার মধ্যে, রাইফেল ঘুরিয়ে নতুন করে তাক করার সময় আর পেলেন না গর্ডন।

গর্ডন হতাশ হয়ে নেমে এলেন, ফিরে গেলেন লাঞ্চটা শেষ করবার জন্য। সবে তা শেষ হয়েছে, এক খোঁজার, দৌড়ে এল ঊর্ধ্বশ্বাসে- বাঘ আবার দেখা দিয়েছে, চলেছে কোহিরার দিকে, তেষ্টা পেয়েছে বোধ হয় তার।

বেলা তখন প্রায় তিনটে। গর্ডন রওনা হলেন চার জন লোক সঙ্গে নিয়ে। সেই তাজ, শেখ আর সেই বালা দোসাদ ত আছেই, আর আছে দু’জন নতুন খোঁজার- হীরা আর নানক। কোহিরার ধারে পৌঁছেই তারা দেখল, বাঘ আগেই এসে গিয়েছে সেখানে। পাড়ের উপরে একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে গর্ডন ঘোড়া টিপলেন, মাত্র কুড়ি ফুট দূরে থেকে। লাগল বাঘের নীচের চোয়ালে। দৌড়ে গাছে উঠে পড়েছে শিকারীরা। গর্ডনের মুশকিল, তাঁর জুতোর তলায় রবার দেওয়া, পা ফসকে যাচ্ছে গাছ থেকে। বাধ্য হয়ে তিনি গড়িয়ে পড়লেন পাড় থেকে নীচে। লুকিয়ে পড়লেন একটা ঝোপের আড়ালে। বাঘ ওদিক থেকে ধেয়ে আসছে সেই ঝোপই লক্ষ্য করে!

বাঘ রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। জখম হচ্ছে বারবার, ঘাড় ফুলে ডবল, সেখানে ব্যথা অসহ্য, গাছের উপরে বালা দোসাদকে দেখতে পেয়ে সেই গাছের নীচে খাড়া হয়ে উঠল পিছনের পায়ে ভর দিয়ে। বালাকে ধরতে পারল না। তার পাগড়ি খুলে ঝুলেছিল, বাঘ কামড়ে ধরল সেই পাগড়ি। পাগড়ি তাকে সমর্পণ করে দিয়ে বালা ধাঁই ধাঁই করে উঠে যেতে লাগল উপর থেকে আরও উপরের ডালে। বাঘ ধপ্ করে নেমে পড়ল চার পায়ের উপরে আবার, পাশেই দেখল একটা শুকনো গাছের সাদা গুঁড়ি, নিষ্ফল রোষে চিবাতে লাগল সেটাকেই, যেন সেটা মানুষেরই ধড় একটা।

এ-ব্যাপারটা যেখানে হচ্ছে, পাড়ের নীচের থেকে সে জায়গাটা নজরে আসে না গর্ডনের। তিনি একটা শোরগোল লাফ ঝাঁপের শব্দ পাচ্ছেন, ভাবছেন, তাঁর সাথীরা কেউ পড়ে গিয়েছে বাঘের মুখে। ব্যাপারটা বুঝবার জন্য তিনি মাথা তুললেন, আর তক্ষণি তাঁর চোখোচোখি হয়ে গেল তার সঙ্গে। কে এক গোয়ো শিকারী ময়ূর ধরবার মাচান তৈরি করেছিল কবে, কুল্যে পাঁচ ফট উঁচু। তারই উপরে উঠে বসেছে তাজ। গর্ডনের সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ামাত্র সে হাত নেড়ে ইশারা করল —“লুকোও সাহেব, লুকিয়ে পড়, মাথা নামাও।” গ্রহের ফের ইশারাটার ভুল অর্থ বুঝলেন গর্ডন। তিনি ভাবলেন–তাজ, তাঁকে উঠে আসতে বলছে তারই কাছে, মাচানের উপরে। তিনি তাজের দিকে যাওয়ার জন্যই পা বাড়িয়েছেন, এমন সময় বাঘের নজরে পড়ে গেলেন তিনি। বাঘ অমনি দিল লাফ, গর্ডনের টুটি তাক করে।

অন্য লোক জ্ঞান বৃদ্ধি হারিয়ে ফেলত এ অবস্থায়, গর্ডন তা হারালেন না। তিনি মাথাটা নীচু করে এক পাশে সরে গেলেন, বাঘ লাফের মুখে তাঁর পাশ দিয়েই বেরিয়ে গেল সাঁ করে। কিন্তু ফিরে আসতেও কয়েক সেকেন্ড মাত্র লাগল তার। এবার মাত্র চার ফুট দূর থেকে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাহেবের উপরে, এবারে আর রক্ষা পেলেন না তিনি। মাথায় ছিল সোলার টুপি, গলাটা ধরতে পারে নি বাঘ, কিন্তু সাহেবকে মাটিতে ফেলে সে চেপে বসেছে তাঁর উপরে।

বাঘ এসে যখন পড়ল তাঁর উপরে, তখনই বন্দুকটা ছিটকে পড়ে গিয়েছে তাঁর হাত থেকে। শুয়ে শুয়েই সাহেব বন্দুকটা হাতড়াচ্ছেন। পাচ্ছেন না। অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে। বাঘ তাঁর গলাটা খুঁজছে কামড় বসাবার জন্য। গর্ডন ডান হাত দিয়ে আগলাচ্ছেন গলা। বাঘের হাঁ-করা মুখের মধ্যে ডান কনুইটাই ঢুকিয়ে

দিয়েছেন। এদিকে বাঁ-হাত দিয়ে কোমর হাতড়াচ্ছেন, ওখানে একখানা লম্বা ছোরা বরাবর থাকে তাঁর। যখন যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তখনই অভ্যাসটা হয় কোমরে ছোরা গুঁজে রাখার। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ, কয়েকদিন আগে টোটার থলের ভিতর ছোরাটা রেখে দিয়েছিলেন, জিগনি-গাঁয়ের বৈজনাথের জিম্মায়, তা আর তুলে নেওয়া হয়নি। বাঘ চিবাচ্ছে, চিবাচ্ছে, সাহেবের হাতখানা কেবলই চিবাচ্ছে। অসহায়ের মত তাজ, আর বালা আর হীরা আর নানক দেখছে তা। সাহেবের রাইফেল তারা কুড়িয়ে নিয়েছে। ওরা কি গুলি চালাবার মতলব করছে না কি ?

হঠাৎ সাহেবের মনে হল-

হ্যাঁ, বাঘের দাঁত তাঁর হাত চিচ্ছে, বাঘের নখ তাঁর সারা দেহ ফালা ফালা করে চিরে ফেলছে, সেই অবস্থাতেও তাঁর মনে হল—

মনে হল যে বাঘটা ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে আসছে, তাঁকে মেরে ফেলবার আগে বাঘই হয়ত মরে যাবে আপনিই। বাঘের দিক থেকে মৃত্যুর আশঙ্কা তাঁর হয়ত তত বেশী নেই। কিন্তু ঐ হীরা, নানকেরা যদি রাইফেল চালায়, তাতে বাঘ না মরে তাঁরই মরার সম্ভাবনা অনেক বেশী। আনাড়ীর হাতের গুলি তাক-মাফিক লাগে না কখনো। যেহেতু ওরা তাক করবে বাঘকেই, সেই হেতুই ওদের গুলি বাঘকে না ঘায়েল করে করবে তাঁকে।

যেই একথা মনে হওয়া, তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন—“খবর্দার, তোমরা গুলি চালিও না যেন। বাঘ এমনিই মরবে।”

সে-কথার উত্তরে মাচান থেকে তাজ, হেঁকে বলল – “হুজুর! চুপ, চুপ! কথা কইলেই বাঘ খেয়ে ফেলবে তোমায়। চুপ করে থাকলে মড়া মনে করে ছেড়ে দিতেও পারে।”

এই হাঁক দিতে গিয়েই তাজ, পড়ল বিপদে! তার স্বর লক্ষ্য করে বাঘ লাফ দিল তার দিকেই, সাহেবকে ছেড়ে দিয়ে। তাজ, তা দেখে মাচান থেকে লাফিয়ে পড়ল নদীর ভিতর। মুখখানা পড়ল এক চাড় পাথরে, তিনটে দাঁত ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেল।

তার পিছনে পিছনে বাঘও লাফ দিয়েছিল। কিন্তু তার নয়-নং একাশিটা জানের মধ্যে আশিটাই তখন বেরিয়ে গিয়েছে দেহ থেকে, অবশিষ্ট একটাকে সম্বল করে সে গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়ল একটা ডোবার মধ্যে। আর উঠল না সে।

ওদিকে হীরা নানকেরা তখন গর্ডনকে তুলেছে একটা মইয়ের মত জিনিসের উপরে। দুখানা লম্বা গাছের ডাল সমান্তরালভাবে মাটিতে পেতে তাদের সঙ্গে বেধে দিয়েছে বালা দোসাদের পাগড়ি। সেই অভিনব স্ট্রেচারে করে তারা গর্ডনকে নিয়ে গেল গ্রামের ভিতরে। গর্ডনের ভাগ্য ভাল, ঠিক সেই সময়ই বানারস থেকে, গাঁয়ের জমিদার কিশোরীমন সিং এসে পড়লেন তাঁর নিজের বিষয়কর্ম উপলক্ষে। তাঁর সঙ্গে ছিল জীপ, সেই জীপেতেই গর্ডন রওনা হয়ে গেলেন বানারস হাসপাতালে। তিন মাস পরে তিনি বেরুলেন হাসপাতাল থেকে। তাজ, শেখের তিনটে দাঁত ভেঙ্গেছিল, সেখানে সে বসিয়ে নিল তিনটে সোনার দাঁত। মুখের জৌলুস বেড়ে গেল তার।

Tags: , , , , ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!