ভালাইথড়ুর সন্ন্যাসী বাঘ

September 4, 2023

বুনো হাতীটা বড়ই উপদ্রব শুরু করেছে। তছনছ করে দিলে কলাবাগানটা। রেগে মেগে সেকেলে গাদা-বন্দুকটা মাচা থেকে পেড়ে নিয়ে এল কণ্ঠ। ধূলো ময়লা আর ঝল কালির একটা পলেস্তারা পড়ে গিয়েছে তার গায়ে, ছেলেকে লাগিয়ে দিল সেগুলি পরিষ্কার করতে। ছেলে বলল—“হাতী মারা ত নিষেধ হয়ে গিয়েছে বাবা !” দাঁত খিচিয়ে কণ্ঠ বলল—“নিষেধ না হলেই যেন আমি মারতে পারতাম হাতী ! ওরে, অত উঁচুদরের শিকারী তোর বাপজান নয়। দুই একটা ছররাও যদি লেগে যায় জানোয়ারটার গায়ে, ভয় পেয়ে যেতে পারে, আর না আসতে পারে এমুখো।” নীলগিরি পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঐ যে একশো বাইশ মাইল-জোড়া মহারণ্য, তারই লাগোয়া এই কলা-বাগিচাখানি। জঙ্গল আর বাগিচার মধ্যে চারিধার-ঘোরানো এক ফালি ফাঁকা মাঠ ফেলে রেখেছে কণ্ঠ, যাতে বনের জানোয়ারেরা বুঝতে পারে যে তাদের এলাকা ঐখানেই শেষ, আর এগুলে সেটা হবে অনধিকার-প্রবেশ। সাধারণতঃ দাঁতালেরা পেরোয় না এই সীমান্ত, কিন্তু এই যে একটা গন্ডা হাতী হঠাৎ এল কোথা থেকে—ওকে হাঁকাতে না পারলে এত সাধের কলাবাগিচা কন্ঠের গোল্লায় গেল একেবারে। নিশুতি রাত, সরু, এক ফালি চাঁদ আকাশে। ফাঁকা জায়গাটার দিকে মুখ করে কলাঝাড়ের জমাট অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছে কণ্ঠ, হাতে সেই গাদা-বন্দুক। মশার কামড়, দুর করা যাবে কী? সাপের ভয়? বরাতে লেখা থাকলে কে খণ্ডাবে? আজ রাতে দুনিয়ার সেরা অদৃষ্টবাদীর নাম হচ্ছে শ্রীযুক্ত কণ্ঠ। ঐ যে! একটা কালো কলেবর দেখা দিয়েছে না? ওমা! এ ত হাতী নয়, এ যে বাঘ! প্রায় হাতীরই মত মস্ত বটে, কিন্তু বাঘ এটা। হয়েছে! জঙ্গলের বাঘ এটা নয়, সাধুবাবার বাঘ। সাধুবাবা এসে ভালাইথোড়ুতে অধিষ্ঠান করার সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিশাল বাঘ এসে ডেরা নিয়েছে নিকটেই কোথাও । নাজেহাল করে তুলেছে বয়েল-পট্টির রাখালগুলোকে।

শালগাড়ির দেওয়াল টপকে বাথান থেকে গরু, তুলে নিয়ে যাচ্ছে রাতের বেলায়, দিনদুপরে জঙ্গলের ধারে ভইস চরছে দল বেঁধে, লাফিয়ে পড়ে তাদের ভিতর থেকে একটা বাচ্চা তুলে নিয়ে আর এক লাফে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের ভিতর। অতিষ্ঠ, ত্রস্ত হয়ে উঠেছে এ-তল্লাটের লোক । সবচেয়ে বিপদের কথা, বাঘটা হয়ত এবার মানুষখেকো হয়ে গেল। কয়েকদিন আগে একটা রাখাল মারা পড়েছে ওর হামলায়। পালের একটা বাছুর ওর গ্রাসে পড়েছে দেখে দুঃসাহসী রাখালটা এগিয়ে গিয়েছিল তাকে উদ্ধার করতে। ফলে সে ত মারা পড়লই, এ-অঞ্চলের তাবৎ লোককে ফেলে রেখে গেল দারুণ সংকটে।

এক খাবলা মাংস তার গা থেকে এক কামড়ে ছিড়ে নিয়েছিল বাঘটা। খেয়েও ছিল নিশ্চয়ই। সে-স্বাদ আর কি ভুলবে সে? এবার থেকে গোরু-মোষের চাইতে বেশী করে তার তাক থাকবে রাখালের উপরে। এ-অঞ্চলের তাবৎ লোক পড়েছে সংকটে। সে-সংকট থেকে কলাওয়ালা কণ্ঠ যদি আজ তাদের উদ্ধার করে, কেমন হয় সেটা? কণ্ঠ নিজের মনে মনে আওড়ালো—খুবই ভাল হয় সেটা। যে ছিল কলাওয়ালা, রাতারাতি সে হয়ে ওঠে বাঘ-শিকারী। একটা গৌরবোজ্জ্বল ভবিষ্যতের দ্বার খুলে যায় তার সমুখে। আর দেরি নয়। গাদা বন্দকের ঘোড়া টিপে দিল কণ্ঠ। সঙ্গে সঙ্গে আহত বাঘের ক্রূদ্ধ গর্জন। নীলগিরির জঙ্গলে বাঘ এত বেশী যে কোলের শিশুটাও (বাঘের নয়; মানুষের শিশু) বিলক্ষণ জানে যে কোন অবস্থায় পড়লে কী রকমের ডাক ডাকে।

কলাবাগিচার স্থানীয় নাম বাঘেরা। এ-যা একখানা ডাক শুনল কণ্ঠ, বাঘ জখম না হলে তেমন ডাক বেরোবে না তার কণ্ঠ থেকে। কিন্তু তার পরের আওয়াজটা? চিৎকার দু’টোই হয়েছে, এতে কণ্ঠ একেবারে নিঃসন্দেহ। একসাথে মেশানো, তালগোল পাকানো বটে, কিন্তু যতই পাকাক তাল- গোল, বাঘের গর্জন আর মানুষের গর্জন কি বেমালুম মিশতে পারে কখনো? কণ্ঠ হলফ নিয়ে বলতে পারে—বাঘও গর্জালো, একটা মানুষ ও চ্যাঁচালো। আচমকা কঠিন ঘা খেলে মানুষ যেমন ককিয়ে ওঠে তারস্বরে, যে-কঁকানির মূলে থাকে যন্ত্রণার চেয়ে আতঙ্ক বেশী, তেমনি যেন কঁকিয়ে উঠল মানষও একটা। আর তারপর, চাঁদটা লাকিয়ে পড়েছে বনের আড়ালে, তব, কণ্ঠ যেন দেখল, অস্পষ্টভাবে হলেও দেখল সে দু’চোখ মেলে, এক সঙ্গে দুই দিক পানে দু’টো জীব দৌড়ে পালাচ্ছে। বনের দিকে যেটা দৌড়ালো সেটা চতুষ্পদ, কিন্তু সাধু বাবার ডেরার দিকে পালালো যেটা, সেটা দ্বিপদ না হয়ে যায় না। সাধু বাবার ডেরার দিকে!

মানুষ বলতে এদিকটাতে ত স্বয়ং ঐ বাবা ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। মাইল-জোড়া কলাবাগিচার একেবারে অন্য প্রান্তে বাস করে কন্ঠ, উটি-মিসিংগুড়ি সড়কের ধারে। একেবারে নির্জন নিরালা বলে এই দিকটাই বাসস্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বাবা। সাধন ভজনের জন্য নিরালাই ত দরকার বিবাগী মানুষের! সাধু বাবা ছাড়া অন্য মানুষ নেই ধারে কাছে কোথাও। অথচ, কণ্ঠ যদি মতিচ্ছন্ন না হয়ে থাকে, তাহলে বাবার কুড়ের দিকে দৌড়ে যাকে পালাতে দেখল সে, মানুষে না হয়ে অন্য কিছু, সে হতেই পারে না। কলাঝাড়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ভাবছেই কণ্ঠ। বুনো হাতীর কথা আর মনেই নেই তার। এটা ব্যাপার কী হল? কী হল এটা। কুড়ের দিকে ছুটে যে পালাল, সে যদি খোদ সাধু বাবাই হয়, তা হলে ত মহাপাতকই করে ফেলেছে কণ্ঠ। সাধু রক্তপাতের দরুন কত যুগ নরকের আগুনে পড়তে হবে তাকে, ঠিক কী তার ? কিন্তু নরক ত পরের কথা, আপাততঃ কণ্ঠ যা ভাবছে, তা হল এই যে এত রাত্রে সাধু বাবা কুঁড়ে থেকে বেরুবেন কোন প্রয়োজনে? বিশেষ করে একটা মানুষ খেকো বাঘ যখন কয়েক মাস থেকেই দিনে রাতে হানা দিয়ে ফিরছে, এই গোটা অঞ্চলটায়, ভালাইথোড় থেকে মিসিংগাড়ি পর্যন্ত। বেরনো মানেই যে জীবনটাকে অহেতুক বিপন্ন করা, তা কি আর তিনি বোঝেন না ?

খুবই ইচ্ছে হচ্ছিল কণ্ঠর, সেই রাত্রেই কুড়েতে গিয়ে সাধুর সঙ্গে দেখা করে। গাদা বন্দুকের গলিতে জখম যে লোকটা হয়েছে, সে সত্যই সাধু কিনা, এইটি যাচাই করে আসার জন্য। কিন্তু অনেক ভেবে-চিন্তে সে-ইচ্ছে কণ্ঠ দমন করল। জখম যদি সাধুই হয়ে থাকেন, আর ঠিক এই রাত্রেই কন্ঠ যদি সাধুর কাছে যায়, তাঁর কুশলবার্তা জানবার জন্য, তাহলে ত প্রকারান্তরে স্বীকার করাই হয়ে গেল যে আততায়ী সে ছাড়া আর কেউ নয়! থাকুক এখন ! কাল সকালে ছেলে ত যাবেই সিধে নিয়ে, তার মুখ থেকেই শোনা যাবে সব।

হ্যাঁ, সাধুর কাছে সিধে রোজ সকালেই পাঠায় কণ্ঠ। ছয় মাস আগে তিনি প্রথম যেদিন পায়ের ধূলো দিলেন ভালাইথোড়তে, সেই দিন থেকেই। সিধে বলতে সুপক্ক সুরসাল সুস্বাদু  কলা এক থালা, তার উপরে প্রচুর পরিমাণ ক্ষীর এবং তারও উপরে পর্যাপ্ত পরিমাণ চিনি। এইটি সাধুর প্রাতরাশ। দুপুরে বা রাত্রে কী তিনি সেবা করেন, সে-খবর আর রাখে না কণ্ঠ, সাহসই হয় না খবর নেবার। নিতে গেলেই দায়ঝক্কি তার ঘাড়ে পড়বে।

ঘটনাটা ঘটেছিল এই রকম।মাস ছয়েক আগে এক শুভপ্রভাতে শালপ্রাংশ, মনুমান এক গেরুয়াধারী এসে পায়ের ধূলো দিলেন কন্ঠের কলাবাগিচায়। গৌরকান্তি এই গেরুয়াধারী এসে পায়ের ধুলো দিলেন কন্ঠের কলাবাগিচায়— “আমি পদব্রজে হিমালয় থেকে কুমারিকা পর্যটন করবার জন্য বেরিয়েছি। নীলগিরির মাথায়উঠব ওখানকার বৈষ্ণব তীর্থটি দর্শনের আশায়।  চাই তোমার গৃহে আজকের রাতটা—বিশ্রাম নিতে”-

কণ্ঠ ত চরিতার্থ একেবারে। সন্ন্যাসীর পরিচর্যার যথোচিত ব্যবস্থা করে দিয়ে সবিনয়ে নিবেদন করল—“হিমালয় থেকে আসছেন, নিশ্চয়ই দেহ ক্লান্ত ও অবসন্ন। অন্ততঃ সাতটা দিন বিশ্রাম নিন এই দীনের ভবনে। তাতে আপনিও দেহে বল পাবেন, আমারও পূণ্যে লাভ হবে সাধ-সেবার ফলে।’

সাধু তখন ক্ষীর শর্করা সহযোগে গপাগপ উদরস্থ করে যাচ্ছেন পশ্চিমঘাট অঞ্চলের দেবভোগ্য রম্ভা, একটার পরে একটা, গণ্ডার পরে গণ্ডা, দ্বিধা না করে রাজী হয়ে গেলেন শ্রীমান কণ্ঠকে সাধ, সেবার সংযোগ দিতে। রয়েই গেলেন কিছুদিন। এ অঞ্চলে ত কণ্ঠই একমাত্র পণ্যার্থী নয়! তার মত বর্ধিষ্ণু, গেরস্ত অবশ্য আর কেউ নেই ধারে কাছে, কিন্তু গরিবেরাও পালা করে সিধে পাঠাতে লাগল প্রতিদিন, চাল, ঘি, সবজি, যব—যাবতীয় সব কিছু। তার ফলে
সাধুর কুমারিকা- যাত্রার দিন ক্রমেই পিছিয়ে যেতে লাগল। অবশেষে তিনি মনোবাসনাটি খুলেই বললেন—“নিরিবিলি জায়গায় একখানা খড়ের চালা আমায় তুলে দাও যদি কণ্ঠ বাবাজি, আমি আর যাই না কোথাও। স্থানটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। সাধনার উপযুক্ত স্থানই বটে। মন চাঙ্গা ত কটোরেমে গঙ্গা। মন যখন বসে গেল কোন জায়গায়, জানতে হবে যে সেইখানেই ভগবান বসে আছেন আমার প্রতীক্ষায়।”

খড়ের চালা? সে আর বেশী কথা কী? খড় বল বাঁশ বল, কেটে আনলেই হল, দাম ত আর দিতে হবে না তার! ঘর তৈরী হয়ে গেল বাবার।
আগেই বলা হয়েছে, এদিকে
সাধুর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই এক দুর্দান্ত বাঘের আমদানি হয়েছিল ভালাইথোড়র আশেপাশে। দেদার বাঘ অবশ্য আগেও ছিল এখানে, তবে তারা জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে ঢোকে নি কখনো। এ-বাঘ এসেই হানা দিতে লাগল মোষের বাথানে, গোরুর গোয়ালে। রাখাল একটাকে খেয়েও ফেলল একদিন। উটি-সড়কের এধার ওধার থেকে পাঁচখানা গাঁয়ের লোক এসে কেঁদে পড়ল সাধুবাবার শ্রীচরণে—“বাবা, এ-দুশমনের হাত থেকে তুমি ছাড়া আর কেউ বাঁচাতে পারবে না আমাদের। কিছু তুকতাক তোমায় করতেই হবে—যাতে ও অন্যদিকে চলে যায়, আমাদের জান-মালের লোকসান আর যাতে ও না করে।

সাধু বাবা এ-প্রার্থনার উত্তরে যা বললেন—তা শুনে পিলে চমকে গেল প্রার্থীদের। “এ-বাঘ হল আমারই বাঘ। আমি যেখানে যাব, বাঘও সেখানেই যাবে। একটা বেশীঅত্যাচার হয়ে যাচ্ছে তোমাদের উপর, এ্যাঁ? তা আমি ওকে সংযত হতে বলে দেব। অন্ততঃ মানুষগলোর ঘাড় যাতে না মটকায়- ” ”
এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ অন্য কথায় চলে গেলেন বাবা – “দেখ, সিধেটা নিয়মিত পাচ্ছি না। আর চালটাও আসছে বিশ্রী। বাঘকে আমি রাখব, কিন্তু আমার খাওয়া- দাওয়ার কষ্ট যাতে না হয়, সেটাও তোমরা বাপ, দেখতে চাও এখন থেকে। আর, একটি মঠ আমি প্রতিষ্ঠা করব এখানে, তার খরচও তোমাদের তুলে দিতে হবে। সব কয়টা গ্রাম থেকে সবাই মিলে চাঁদা করে মাসে একশো টাকা যদি জমা দাও আমার হাতে, দুই বছরেই মঠের কাজ শুরু হয়ে যেতে পারবে! তোমাদেরই কাজ। ভগবানের পীঠস্থান হবে তোমাদের ঘরের সম্মুখে। ড্যাং ড্যাং করে তোমরাই যাবে উদ্ধার হয়ে।”

এ-ক-শো টাকা ! মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল লোকগুলোর। নেহাতই গরিব যে তারা ! একটা পয়সা সঞ্চয় হয় না কারও। দু’বেলা পেট ভরে খাওয়া বরাতে জোটে না এক এক সময়, একশো টাকা তারা কোথা থেকে দেবে? দাবিটা কমিয়ে পঞ্চাশে নামাবার জন্য মোড়লেরা অনেকই সাধ্যসাধনা করল,
সাধু তাঁর দাবিতে অটল। কঠিন কথা শুনিয়ে দিলেন শেষমেশ—“ভগবানের কাজে পয়সা খরচ করতে অরাজী যারা, তাদেরই আক্কেল দেওয়ার জন্য বাঘের সৃষ্টি হয়েছে দুনিয়ায়।”
ভয়ে বুকের ভিতরটা জমে একেবারে বরফ লোকগুলোর। কিন্তু করবে কী! টাকা এমনি একটা জিনিস, যা না-থাকলে দেওয়া যায় না, বাঘের মুখে থেকে জান বাঁচাবার প্রয়োজনেও যায় না। একশো টাকা তারা দিতে পারল না, সুতরাং বাঘের তাণ্ডবও ক্রমশঃ বেড়ে চলল। এমন হপ্তা যায় না, যাতে দুই একটা মানুষ না মরে। গরু-মোষ? সে যে কত মরছে, তার ত লেখাজোখা নেই।
সারা দেশে প্রথমে রটনা হয়ে গেল, সন্নিসী মন্তর জানে, বাঘ লেলিয়ে দিয়ে লোকের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে রটনাটাতে প্রকারভেদ দেখা দিল একটা। লোকে এখন বলাবলি করছে—লেলিয়ে দেওয়ার কোন প্রশ্নই নেই এ- ব্যাপারে। সন্ন্যাসীই বাঘ, বাঘই সন্ন্যাসী। যখন যে-মূর্তি দরকার, তখন সেই মূর্তিই ধারণ করছে। এদেশ শ্মশান ক’রে দেবে ঐ বাঘ-সন্ন্যাসী !
এই রকমই ঘোরালো যখন পরিস্থিতি, তখনই এক রাত্রে কণ্ঠর গাদাবন্দুকের গুলি ছুটল বাঘ লক্ষ্য করে, আর তার ফলে যে-চিৎকারটা নিশীথ রাতের নিশ্ছিদ্র নীরবতা দীর্ণ করে দিয়ে ধ্বনিত হয়ে উঠল ভালাইথোড়র কলাবাগানে, তার ভিতর মানুষের আর্তস্বর শুনে চমকে গেল কণ্ঠ।

পরদিন সকালে প্রাতরাশের সিধে নিয়ে কণ্ঠর ছেলে গিয়েছে সন্নিসীর কুড়েতে। থালা-ভরা কলার টুকরো, তার উপরে ক্ষীর, এবং ক্ষীরের উপরে চিনি। কুড়ের দোরে পোঁছেই সে শিউরে উঠল—রক্তের দাগ দোরগোড়ায়।
দোর বন্ধ তত বেলাতেও। ধাক্কা দিতেই ভিতর থেকে রুদ্ধ তর্জন শোনা গেল— “খাবার কলা পাতায় চাপা দিয়ে রেখে চলে যা! আমি এখন উঠতে পারছি নে, আমার অসুখ করেছে।”
বাঁশেরই বেড়া ঘরে, মাঝে মাঝে ফাঁক আছেই তাতে। তারই একটাতে চোখ লাগিয়ে যখন উঁকি দিল ছেলেটা, শিউরে উঠল সে আর একবার। শয়ে নেই সাধু দাঁড়িয়ে আছেন ঘরের ভিতর। কাঁধে কাপড় বাঁধা। সেই কাপড়ের তলা দিয়ে রক্ত চোঁয়াচ্ছে তখনও।
এতক্ষণ ত গেল ভণিতায়, অর্থাৎ ভালাইথোড়র স্বামীজির ইতিহাস বর্ণনে। কিন্তু কলা- বাগিচার দুর্ধর্ষ নরখাদকটার সঙ্গে মোকাবিলা করা র ব্যাপারটা অত্যধিক কঠিন ও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল কী কী কারণে, তা বোঝাতে হলে এ-ভণিতা তথা এই ইতিহাস না বলে উপায় ছিল না।

আগ্রায় বসে ভারতখ্যাত বাঘশিকারী কেনেথ অ্যান্ডারসন পেলেন একখানা চিঠি। বন্ধ, স্যাটসেল লিখেছেন উতকামণ্ড থেকে। ভালাইথোড়র ঐ বাঘ! চিঠিতে আগাগোড়া তারই কথা। স্যাটসেল বলছেন—“তুমি আগে উটিতে চলে এস আমার কাছে। আমি যতদূর যা বলতে পারি, তা শোন। তারপর নেমে যাও ভালাইথোড়তে সোজা রাস্তা বেয়ে। মাত্র বারো মাইল পথ, তকলিফ কিছু, হবে না তোমার।”
চড়কে পিঠ, ঢাকের বাদ্যি শুনলেই চড়চড়িয়ে ওঠে। অবিলম্বে কেনেথ এসে হাজির উটিতে। একটা মাত্র প্রাত:রাশ বন্ধুর বাড়িতে খেয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়ে পড়লেন ভালাইথোড়র উদ্দেশে। এ তাঁর পুরোনো জায়গা। আগেও এ জঙ্গলে বাঘ শিকার তিনি করেছেন।
বেলা চারটে নাগাদ ভালাইথোড়তে পৌঁছে গেলেন। দেখা দিলেন গিয়ে ইরলো উপজাতির এক ভূতপূর্ব সহকারীর বাড়িতে। সত্যি সত্যি নাম যে তার কী, তা কেনেথ কোনদিন জানতে পারেন নি, দীর্ঘদিনের সাহচর্যেও। চুল-টুল সাদা হয়ে এসেছে বলে সর্বসাধারণেই বুড়ো বলে ডাকে তাকে। বেটে খাটো হালকা ধরনের মানষটা, কিন্তু বনে জঙ্গলে ঘোরাফেরায় যে-দৃঢ়তা আর সহিষ্ণু, তার পরিচয় সে বরাবর দিয়েছে এর আগে, অন্য সব জায়গার বনতাড়ুয়াদের মধ্যে কদাচিৎ তা দেখেছেন কেনেথ ।

“ভালাইথোড়র বাঘ?” নিজের হাতে নাক-কান মলে বুড়ো বলল—“ভালাইথোড়র স্বামীজি, বল সাহেব। ও-বাঘ ত বাঘ নয়, স্বামীজিরই অন্য এক চেহারা। তবে তুমি পুরোনো মনিব। আর শিকারই তোমার পেশা। এ-তল্লাটে বাঘ-স্বামী উৎপাতও করে চলেছেন বড় বিষম। তা, তুমি যা বল সাহেব, তাই হবে।”

ভালাইথোড়র কলাবাগিচা বেড় দিয়ে একটা ছোট্ট নদী চলে গিয়েছে দক্ষিণ পানে, দুই কালেই দুর্গম অরণ্য তার। বাগিচার মাইল-খানিক দূরে এক পেল্লায় আমগাছের নীচে রাত কাটাতে মনস্থ করলেন কেনেথ। তার জন্য দরকার আর কিছু নয়, সারা রাত দাউ দাউ জ্বলেও নিঃশেষ হবে না, এই রকম পাহাড়প্রমাণ শুকনো কাঠ। বাঘ বল, হাতী বল, আগুনকে সমীহ না করে কে?
তা কত শুকনো গাছ পড়ে আছে জঙ্গলে, কাঠের অভাব কী! সন্ধ্যার আগেই মস্ত আগুন জলে উঠল আমগাছের নীচে। বড়োকে পাশে নিয়ে কেনেথ বসলেন ঘাঁটি হয়ে। এক কানে শুনবেন বড়োর গল্প, অন্য কান খাড়া রাখবেন বাঘের ডাক শুনবার জন্য। বাঘ আছে যখন, সে ডাকবেই। কখন কোন্ দিকে ডাকে, কখন কী আওয়াজে ডাকে, তা মন দিয়ে শুনলে বাঘের গতিবিধির সম্পর্কে ত বটেই, তার স্বভাব সম্পর্কেও খানিকটা আভাস পেতে পারেন দক্ষ শিকারী।

স্যাটসেল দিয়েছিলেন কাঠখোট্টা একটা তথ্যসর্বস্ব বর্ণনা, তাকে জ্যামিতিক উপপাদ্যও স্বচ্ছন্দে বলা যায়। কিন্তু বড়ো যা বলে গেল ঘণ্টা খানেক ধরে, তাতে তথ্যের চেয়ে তত্ত্ব বেশী। ভালাইথোড়র স্বামী ওরফে সাধু, বাবাই যে লীলাচ্ছলে বাঘের বেশ ধারণ করে থাকেন মাঝে মাঝে, নানা প্রমাণ ও অনুমান প্রয়োগে সেই বিশ্বাসটাই সে সঞ্চারিত করতে চাইছে কেনেথের অন্তরে। সাহেবের হুকুম সে মানবে, চিরকাল মেনে এসেছে, আজই বা কেন মানবে না? চিরকাল মোটা পয়সা কামিয়েছে সাহেবের কাজ করে, এবার যদি মারাই পড়তে হয়, কেয়া পরোয়া ! নিয়তি কে খণ্ডাবে? তবে-
তবে হ্যাঁ, মৃত্যুই যে অনিবার্য নিয়তি, বর্তমান প্রচেষ্টায় অটল থকলে, এটা মনে প্রাণেই বিশ্বাস করে বুড়ো। এবং সাহেবও যে সেটা বিশ্বাস করলে ভাল করবেন, এমন ইঙ্গিত সে প্রতি কথার ফাঁকে ফাঁকে দিয়ে দিচ্ছে কেনেথকে—কহিনীর উপসংহারে সে বলল- “জানো ডোরাই, এখন আমার মনে হচ্ছে,  এসব না বললেই ভাল করতাম আমি। বাঘেদের রক্ষে করবার জন্যে অপদেবতা আছেন এক দল। এই স্বামী বাঘেরও আছে তেমন রক্ষক। সে-দেবতার কান পাতা রয়েছে সারা জঙ্গল জুড়ে। ফিসফিস করেও কোন শিকারী কী বলছে কাকে, তা শুনতে পান সে-দেবতা। এমন কি, শিকারীদের মনের চিন্তাও তিনি পড়ে ফেলেন ছাপার লেখনের মত । আমি যা যা বললাম, তোমাকে, তাও তিনি অবশ্যি শুনেছেন। কাজেই আমার জীবন ত গিয়েই আছে।”

উ’-উ’-উ^ং! আঁ-উং! আঁ-উং-হা! আঁ-উং-হা! উং! উহ!
“আমার জীবন ত গিয়েই আছে”–বুড়োর এই শেষ কথার সমর্থন হিসেবেই যেন বাঘ গর্জে উঠল একটা সেই মুহুর্তেই। নদীর ওপারেই গর্জালো। কেনেথের ত মনে হল—দুশো বা আড়াইশো গজের মধ্যেই আছে বাঘটা।
ঝড়ো ত ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল বাঘের ডাক শহর, হতেই। তারপর সে কাঁপতে লাগল থরথর, থরথর! গলা তার কাজে আসছে কথা বলতে গিয়ে—“ডোরাই! ঐ তিনি! সেই শয়তান বাঘ! সাধু বাবা শুনতে পেয়েছেন আমার কথা। আমার হয়ে গেল।”

কেনেথের ঘাড়ের খাটো খাটো চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠতে চাইছে। তিনি ভয় পাচ্ছেন, বাঘের ডাকের দরুন নয়। বুড়োর এই সব ভুতুড়ে কথাবার্তায় তাঁর জ্ঞানবুদ্ধি বিবেচনার ভিত টলে উঠতে চাইছে। অলৌকিক অনৈসর্গিক কোন ব্যাপারে তখনো বিশ্বাস ছিল না তাঁর—আজ যেন-আজ যেন—
নিজেকে সাহস দেবার জন্যই তিনি ধমকে উঠলেন বেচারী ইরিলার উপরে— “কী আবোল তাবোল বকছ বুড়ো? যেটা ডেকে উঠল, সে-বাঘটা নেহাতই সাধারণ বাঘ, রক্তমাংস দিয়ে গড়া দেহ তার। সেই মানুষখেকোটাই হতে পারে হয়ত। ঝোপে ঝোপে ভূত দেখো না। ওটা অপদেবতাও নয়, শয়তানও নয়, বাঘের বেশধারী স্বামীজিও নয় ভালাইথোড়ের।”
গুলি-ভরা .৪০৫ রাইফেলটা হাঁটুর উপরে রেখে তিন-সেল টর্চটার আলো ফেললেন কেনেথ সেই দিক পানে, বাঘের ডাক যেদিক থেকে শোনা গিয়েছিল। তাতে কি আর বাঘ দেখা যায় ?
কিছুক্ষণ বাদেই আবার ডাক শোনা গেল। এবার নদীর এপারেই। বাঘটা হেঁটে পার হয়ে এসেছে অগভীর নদী, তারপর অর্ধবৃত্তাকারে একটা চক্কোর দিয়ে কেনেথদের পিছনেই এসে হাজির হয়েছে। কেনেথ বড় একখানা কাঠ ফেলে দিলেন আগুনে। আগুনটাকে মিইয়ে যেতে দেওয়া হবে না কোনমতেই। হয়ত ঐ অগ্নিকুণ্ডের উজ্জ্বলতার উপরেই জীবনমরণ নির্ভর করছে এখন এই দুটো মানুষের।

দ্বিতীয় বার যখন ডাকল বাঘ, তার পর থেকেই বনভূমি স্তব্ধ একেবারে। গভীর, দীর্ঘায়িত, ভুতুড়ে একটা নীরবতা। এর চেয়ে বাঘের ডাকও কম অস্বস্তিকর। বাঘ ডাকলে একটা অন্ততঃ উপকার আছে, বোঝা যায় যে কত দূরে সে আছে, কোন দিকে। আর সে যখন ডাকে না, তখন? তখন, তুমি কিছুই জানছ না, সে হয়ত ঠিক তোমার পিঠের কাছেই এসে হাজির হয়েছে। স্তব্ধ অরণ্য, স্তব্ধ প্রকৃতি, বুড়োটা কেবল বিড়বিড় করছে -“কালকের ভোরের আলো আর আমাদের দেখতে হবে না।” কেনেথ রেগে উঠলেন—“তুমি আর কুডাক ডেকো না ত!” কে কার কথা শোনে। বুড়ো ইরিলা বকেই যাচ্ছে আপন মনে—“কালকের ভোরের আলো আর-” নদীর চড়ায় ডেকে উঠল একটা সম্বর হরিণ—“হই-অঙ্ক ! উ-উঙ্ক! ঢ্যাঙ্ক! ঢ্যাঙ্ক!” দুটো ডাকের মধ্যে কয়েক সেকেণ্ডের একট, বিরাম। সম্বরটা যে ভয় পেয়েছে নিদারণ, তা বেশ বোঝা যায়।

বাঘটাকে সে হয় দেখেছে, নয়ত গন্ধ পেয়েছে তার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বৃংহণ শোনা গেল এক ভয়ার্ত হাতীর—“টিয়া-য়া-য়াঙ্ক! টিয়া-য়া-য়াঙ্ক! পালের বাচ্চা হাতী গুলো সমস্বরে চ্যাঁচাতে লাগল মিহি গলায় কুইঙ্ক ! কুইঙ্ক ! কুইঙ্ক ! ” ঠিক শুয়োর বাচ্চার মত আওয়াজ। ভয়ে তারা যার যার মায়ের পেটের তলায় লুকোচ্ছে। বাঘ চক্রাকারে ঘুরছে কেনেথদের বেষ্টন করে করে। হাঁউ মাঁউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ। দুটো মানুষ যে কাছেই আছে, তা টের পেয়েছে সে। একেবারে কাছে আসছে না যে ঘনিয়ে, সে শুধু ঐ বিশাল আগুনটার জন্য।
হঠাৎ একটা একটানা ভয়ার্ত চিৎকার। তীক্ষ্ম, গগনভেদী সেই সম্বরটা। গোড়া থেকে সতর্ক হয়েও বাঘের থাবাকে ফাঁকি দিতে পারে নি সে। বাঘে ধরেছে তাকে, ঘাড় মটকে দিয়েছে তার।
হাতীর পাল নিঃশব্দে সরে যাচ্ছে দূরে, দূরান্তরে। কেনেথের সরে যাওয়ার কথাও নয়, উপায়ও নেই। আগুনটাকে জীইয়ে রাখা তার একমাত্র কাজ এখন। বসে বসে উৎকণ্ঠা ভোগা। কী হয়, কী হয়, কণ্টকশয্যার যন্ত্রণা প্রতিমুহূর্তে ।

কিন্তু কালরাত্রি শেষ এক- সময় হল। পূর্বাকাশে আঁধার কেটে যাচ্ছে, কালো রং ফিকে হতে হতে এসে দাঁড়িয়েছে গভীর সমুদ্রের নীল রংয়ে। সেই নীলও গলে গলে যাচ্ছে একটু, একটু করে। দিগন্তলীন মেঘগুলির স্তরে স্তরে প্রতিফলিত হয়ে নানা বরণের গলানো নীল। ঐ বেগুনী, ঐ গভীর ইন্ডিগো, ঐ নীলকান্ত মণির স্নিগ্ধ সাজে! অরণ্যতর দের উঁচু নীচু শীর্ষের ঠিক উপরে ঘূর্ণমান একটা কুণ্ডলী দেখা যায় কুয়াশার, তার মাথায় মাথায় ছোপ লেগেছে কোথাও হলুদের, কোথাও রগরগে কমলা রংয়ের, এবং সব শেষে সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে সদ্য-ঝরা রুধিরের রুদ্ধ রক্তিমায়। এই “নানা বরণের ভাব উচ্ছ্বাস” যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎই চলে গেল,অরণ্য তর শীর্ষে দেখা দিল এক দেদীপ্যমান বহ্নিগোলক। এস এস তুমি, হে তপন! হে তপন! হে ভাস্কর! হে ভাস্কর! তুমি এস! ভোর হতে না হতেই ভালাইথোড়র কলাবাগিচায় দেখা দিলেন কেনেথ।
সাধু বাবার খড়ের কুতুঁড়ের সামনে। বড়োও আছে সঙ্গে, কিন্তু কুকড়ে ছোট হয়ে আছে কেনেথের পিঠের আড়ালে। সাধর সমখে পড়ার সাহস তার নেই। দরোজায় ধাক্কা দিতেই তা খুলে গেল। কেনেথের সম্মুখেই গেরুয়াপরা হাস্যবদন সন্ন্যাসী- “কী সাহেব! এত ভোরে কী মনে করে?”
বুদ্ধিদীপ্ত একখানা মুখে সংকৃষ্ণ দাড়ি আর উদ্ধত গোঁফের আড়ালে। আর বড় বড় লালচে চোখে যা  ‍থেকে ফুটে বেরুচ্ছে, তা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। কেনেথ শান্তভাবে বললেন —“দেখতে এলাম সারা রাত বনে বনে চরা করবার পর সন্নিসী-বাঘ মশাইয়ের ঘুম এখনো ভেঙ্গেছে কিনা।”
বেশ হাসিমুখেই সন্ন্যাসী জবাব দিলেন — “সত্যি কথা যদি শুনতে চাও, এই মাত্রই উঠেছি ঘুম থেকে । ঐ শেয়ালটা, ঐ যে তোমার পিছনে লুকোবার বৃথা চেষ্টা করছে কেবলই, ও অনেক কথাই বলেছে, কী বল ? বলেছে যখন, তখন তুমি সাহেব যে সকালেই ছুটে আসবে আমার কাছে, তা আমি ধরেই নিয়েছিলাম। এঃ, কাল ঐ সম্বরটার দরুন সব ভেস্তে গেল। কাল রাত্রেই তোমায় জলযোগ করব, মনস্থই ছিল আমার। কিন্তু সম্বরটা না পালিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তোমাকে ত পরেও পাব, জানি। সম্বরটাকে ছেড়ে দিলে আর কোনদিন পাব কিনা, ঠিক নেই। তাই তোমায় বাদ দিয়ে চতুষ্পদটাকেই খেয়ে নিলাম কাল ।”

একথা শনে বজ্রাহতবৎ নিষ্পন্দ হয়ে গিয়েছিলেন কেনেথ, এরকম বললে তাঁর তখনকার অবস্থা সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না, বেশ পশ্চাপষ্টিই বলছে পাষণ্ড সন্নিসী, গত রাতে যে-বাঘের ডাক শোনা গিয়েছিল নদীর ধারে, যে-বাঘের থাবায় মারা গিয়েছিল একটা বৃহৎ সম্বর, সে-বাঘ আসলে বাঘ নয়, সে হল বাঘের বেশধারী ঐ সন্ন্যাসী, জনরব যা রটেছে, সন্নিসীর একথায় ত পুরো সমর্থনই পাওয়া যাচ্ছে তার। তবে কি এই কথাই বিশ্বাস করতে হবে? এই অসম্ভব অবিশ্বাস্য কথা? কেনেথ সাহেব মানুষ।

ভণ্ড সন্ন্যাসীকে খাতির করে কথা কইবার পাত্র তিনি নন। “শোনো হে ধূর্ত প্রবঞ্চক বদমাইশ মিথ্যুক, বোকা ইরিলাদের যেভাবে ধোঁকা দিয়েছ তুমি, আমায় পারবে না সেভাবে। অতি পাষণ্ড লোক তুমি । এই গরিব বনোরা তোমাকে রাজার হালে রেখেছিল, লোভের বশে তুমি তাদেরই নানারকম ভয় দেখিয়েছ । চাপ দিয়ে টাকা আদায় করার চেষ্টা করেছ। পষ্ট কথা তোমায় বলছি শোন। কাল যে বাঘটা সম্বর মেরেছে, সেটা বাঘই বটে। তুমি একটা শুকর।”
সন্ন্যাসী প্রথমে হাসল। তারপরই তার মুখখানা হয়ে উঠল ভ্রকুটি কুটিল। রুদ্ধ কণ্ঠে সে বলল—“নিজের চরকায় তেল দাও গিয়ে সাহেব। এসব ব্যাপারে তোমার নাক গলানোর কোন দরকার নেই । গলাতে এলে মারা পড়বে নির্ঘাত।”
বদমাইশটাকে তক্ষণি দু’ঘা বসিয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা হয়েছিল কেনেথের, কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে সে-ইচ্ছা দমন করে ফেললেন তিনি। শুধু খানিকটা তর্জন গর্জন করলেন তার উপরে—“নাক আমি গলাবই, জেনে রাখ মিথ্যুক! এবার যখন বাঘ সাজবে তুমি, খবর্দার, আমার রাইফেলের সামনে যেন এসো না। এলেই তোমার ব্যাঘ্রলীলার শেষ হবে তক্ষুণি ।”
“কিংবা শেষ হবে তোমার শিকারী লীলার”–হেসে এই কথা বলে কেনেথের মুখের উপরে দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিল সন্ন্যাসী।
কেনেথ তখন বুড়োকে নিয়ে চলে গেলেন দুটো গরু কিনতে। বাঘের জন্য লোভানি দিতে হবে ত! বাঘটা যে বাঘই, সন্ন্যাসী যে বাঘ হতে পারে  না ইচ্ছে করলেই, কেনেথের মত শিক্ষিত ইংরেজকেও কি সেকথা বলে দিতে হয়? তিনি ঠিকই জানেন, বাঘ বাঘই। বাঘের উপস্থিতিটাকে নিজের কাজে লাগাচ্ছে ধূর্ত স্বামীজি নানারকম ছলনার সাহায্যে। সবচেয়ে বড় চালাকি হল তার, বাঘ যেখানে ডাকবে, সেইখানেই নিজের উপস্থিতির কথা সে যে-কোন প্রকারে জানিয়ে দেবে নিকটবর্তী মানুষকে ! দু:সাহসী লোক সন্দেহ নেই। বাঘের গায়ে গায়ে ঘুরছে ছায়ার মত। এই ত কাল রাত্রেও এই কাজই সে করেছিল। আমগাছতলায় ও নিশ্চয় গিয়েছিল। তা নইলে সম্বরের মৃত্যুর ঘটনা ও জানল কী করে ?

যা হোক, এবার সন্ন্যাসী বাবাজীর ব্যাঘ্রলীলার শেষ দৃশ্য।

মাচান বেঁধে তাতে বসে আছেন কেনেথ একাকী গভীর রাতে। একটা নালার ধারে। মাটিতে ত্রিশ হাত দূরে একটা বয়েল বাঁধা। বাঘ যে ধারে কাছেই আছে, এতে সন্দেহ নেই কেনেথের। তাই রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত।
বাঘ যে ধারে কাছেই আছে, তাতে নিশ্চিত সন্ন্যাসীও। এই তার আর এক সংযোগ। হাতে কলমে সে দেখিয়ে দেবে যে বাঘ আর সন্ন্যাসী অভিন্ন। বাঘ যেই ডেকে উঠল, সন্ন্যাসীও তুলল একটা অট্টহাসির গররা।
কোন ইরিলা যদি শুনত ঐ দুটো আওয়াজ পিঠে পিঠে, সে নিশ্চয়ই সিদ্ধান্ত করত, বাঘ আর সন্ন্যাসী অভিন্ন। কিন্তু যে লোক বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে বসে আছে যে বাঘ আর মানুষ অভিন্ন হতেই পারে না কখনো, সে এরকম দুটো আওয়াজ এক সাথে শুনলে কী ভাববে ?
অবশ্যই ভাববে যে বাঘও আছে ওখানে, আর তার কাছাকাছিই কোথাও সন্ন্যাসীটাও আছে। দাঁড়াও তাহলে-
মাচান থেকে ক্ষিপ্রবেগে নেমে এসে কেনেথ একটা কাণ্ড করলেন। দুই হাত দিয়ে মুখে ঢেকে মুখ থেকে একটা আওয়াজ বার করলেন হুবুহু বাঘের ডাকের মত। এ বিদ্যা তাঁর শেখা ছিল।
আর তাতেই কাজ হল আশ্চর্য।
যে চিরদিন ছায়ার মত বাঘের গায়ে গায়ে ঘুরছে, সেই দুঃসাহসীর হঠাৎ মাথা গুলিয়ে গেল গভীর আতঙ্কে। দুই দিকে দুটো বাঘ? দুটোই অবশ্য গন্ধ পেয়েছে তার। একটাকে ফাঁকি সে দিতে পারে, বরাবর দিয়েছে। কিন্তু দু’দিক থেকে দুটো বাঘ যদি একসাথে তাকে তেড়ে আসে ?
ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সে দৌড়োলো নিজের কুঁড়ের দিকে। সে কুঁড়ে আধ মাইলের মধ্যেই। কোনমতে সেখানে পৌঁছোতে পারলে তবেই নিরাপদ এ যাত্রা। কিন্তু পোঁছোনো তার হল না। সে যখন দৌড়োলো, বাঘও দৌড়োলো তার পিছনে। কেনেথও ছুটেছিলেন। পাষণ্ড সন্ন্যাসী মারা পড়ুক সত্যি সত্যি, এটা ত আর তিনি চান না! সন্ন্যাসীকে তাড়া করেছে মানুষখেকো, এই সময়ে সেই মানুষখেকোকে নিকাশ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে বলেই তিনি দৌড়েছেন। কিন্তু দৌড়ের প্রতিযোগিতায় বাঘের সঙ্গে মানুষ পারে কখনো ? কেনেথ যখন রাইফেলের পাল্লার ভিতরে পেলেন বাঘকে, তার এক মূহুর্ত আগেই সে সন্ন্যাসীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
সন্ন্যাসীর ঘাড়ে বাঘের থাবা, পিঠে বাঘের থাবা। সে মুখে থবড়ে পড়েছে মাটিতে, বাঘ তার উপরে। এমনি সময় পিছন থেকে কেনেথের গুলি বাঘের মাথা লক্ষ্য করে। বাঘ নেতিয়ে পড়ে গেল চার চারটি গুলি খাওয়ার পরে।
অনেক কষ্টে কেনেথ যখন বাঘকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন সন্ন্যাসীর দেহের উপর থেকে, তখনও নিশ্বাস পড়ছে তার। শেষ নিশ্বাস ফেলবার আগে সে অভিশাপ দিয়ে গেল কেনেথকে—“তুইও মরবি। বাঘ ত আরও রইল নীলগিরির জঙ্গলে!”

কেনেথ এন্ডারসন (১৯১০ – ১৯৭৪) একজন প্রখ্যাত ব্রিটিশ শিকারি ও লেখক।

Tags: , , , , , ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!