বেটটামুগ্লোমের মানুষখেকো

August 14, 2023

অনেকদিন আগে গুথেরা পর্বতমালার  উত্তরাংশের ঢালে অবস্থিত সালেম ‘জেলায় তিনশো একর জমি কিনে অসাধারণ একটা বাংলো তৈরি করে- ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা, কালেকটর সাহেব হিসেবেই যিনি ছিলেন সমধিক পরিচিত। দুর্গাকার সেই বাংলোটি আগাগোড়াই ছিলো পাথরে নির্মিত।

জঙ্গল খুবই পছন্দ করতেন ভদ্রলোক, অকাতরে খরচ করতেন এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে। একদল কুলি সবসময় নজর রাখতো কাঁটাঝোপ বা ল্যান্টানার লতা যেন চারপাশ ঢেকে ফেলতে না পারে। ইদানীং রিজার্ভ ফরেস্টের হাজার হাজার একর জমি ছেয়ে যাচ্ছে ল্যান্টানায়। বন বিভাগ ছাড়াও সরকারের অন্যান্য বিভাগ এই আগাছাগুলোকে ধ্বংস করার অনেক ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। বিষাক্ত ওষুধ ছিটানো হয়েছে, কিন্তু এমন কোনো লাভ হয়নি। লক্ষ লক্ষ হারে বংশবৃদ্ধি করে, এরকম একজাতীয় শাদা ছত্রাক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে; কালো হয়ে গেছে ল্যান্টানা, ঝরে ঝরে পড়ে গেছে সমস্ত পাতা । কিন্তু দুই এক একর জমির ল্যান্টানা ধ্বংস হতে না হতেই কী যেন হয়েছে ছত্রাকগুলোর, একে একে মরে গেছে সব, ল্যান্টানাই জয়ী হয়েছে শেষপর্যন্ত ৷

মাঝেসাঝে, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে, দাবানলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ল্যান্টানা। কিন্তু বর্ষা আসার সাথে সাথে আবার অসংখ্য ল্যান্টানা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

অবশ্য ল্যান্টানার কিছু উপকারিতাও আছে। আচড়ে বা ছড়ে গেলে, ল্যান্টানার পাতাপেষা  লাগিয়ে দিলে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। প্রায় টিংচার আয়োডিনের মতোই কাজ করে এই রস, উপরন্তু এর ব্যবহারে চামড়ায় কোনো রকম জ্বালা পোড়া হয় না ।

যাই হোক, সেই ব্রিটিশ কালেকটরের কথায় ফিরে আসি। স্থানীয় উপ-তালুক অঞ্চলের নামের অনুকরণে নিজস্ব তিনশো একর এলাকাটাকেও তিনি বলতেন বেট্টামুগলোম আর পাথুরে বাংলোটাকে বলতেন ‘বন দুর্গ‘ । নিয়মিতভাবে ল্যান্টানা আর কাঁটাঝোপ পরিষ্কার করায় স্বাভাবিক জঙ্গল বেড়ে উঠেছিলো চমৎকারভাবে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে বেড়ে ওঠা লম্বা ঘাস আকৃষ্ট করেছিলো বাইসন আর হরিণদের এবং স্বাভাবিকভাবেই এরা আকৃষ্ট করেছিলো বাঘ, চিতাবাঘ ও ততোধিক ক্ষুধার্ত বুনো কুকুরদের।

কিন্তু কিছুদিন পর থেকে বদলাতে শুরু করলো পরিস্থিতি। কালেকটর মারা গেলেন, বন দুর্গসহ বেট্টামুগলদের জমিদারি লাভ করলেন একজন অ্যাংলো- ইণ্ডিয়ান। কিন্তু ভূতপূর্ব মালিকের মতো জায়গাটার যত্ন নিলেন না তিনি। ফলে, তৃণভূমিগুলো আবার ছেয়ে গেলো ল্যান্টানা ঝোপে। স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যা কমতে লাগলো বাইসন আর হরিণের কিন্তু সংখ্যা কমলো না মাংসাশী প্রাণী গুলোর, ক্রমেই তারা অস্থির হয়ে উঠল ক্ষুধার জ্বালায়।

তারপর কালচক্রে সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ানও মারা গেলেন একসময়। মালিকানার দাবি নিয়ে এগিয়ে আর এলো না কেউ। চূড়ান্ত অযত্নের কবলে পড়লো বন দুর্গ। চাদনী রাতে গরুর গাড়ি নিয়ে এসে দেয়াল ভেঙে ভেঙে গ্র্যানিটের বড়ো বড়ো টুকরোগুলো খুলে নিয়ে যেতে লাগলো গ্রামবাসীরা। বিনে পয়সায় পাওয়া এসব পাথরের টুকরোয় তাদের কুড়েঘরের চমৎকার দেয়াল হবে। ইতিমধ্যে উধাও হয়ে গেছে বাইসনেরা, হরিণও প্রায় অদৃশ্য। হরিণ খাবার উদ্দেশ্যে সমবেত হওয়া বাঘ, চিতাবাঘ আর বুনো কুকুরেরাও গেলো তাদের পিছু পিছু। ল্যান্টানার ঘন ঝোপের আড়াল পেয়ে যাওয়ায় রইলো শুধু বিভিন্ন জাতের বনমুরগি। নাস্তা করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে মাঝেসাঝে এসে হাজির হলো দু-একটা বাঘ বা চিতাবাঘ, কিন্তু পথভ্রষ্ট কোনো চিতল হরিণ বা বুনো ভেড়া তাদের চোখে পড়লো না ।

ওখান থেকে মাইল চারেকের কিছু বেশি দূরে আইয়ুর গ্রাম। সেখানে বাস করে গুরাপ্পা নামের বছর পঁচিশেক বয়সের এক যুবক। তাদের সম্প্রদায়ের হিসেবে অত্যন্ত দেরিতে বিয়ে করছে। সে। কারণ, পুরুষ হলে সতেরো বা আঠারো আর মেয়েদের তেরো কি চোদ্দ বছরে বিয়ে হওয়াটাই তাদের সমাজে স্বাভাবিক। অবশ্য খুব গরীব বলেই এতোদিন বিয়ে হয়নি ঔরাজার। এতো গরীব লোককে কন্যাদান করতে রাজি হয়নি কোনো পিতাই। কিন্তু শেষ- মেষ একজন রাজি হলো। কারণ, জন্ম থেকেই একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে তার মেয়ে, কানেও প্রায় কিছু শুনতে পায় না বললেই চলে।

বিয়ে তো ঠিক হলো কোনো মতে, কিন্তু মুশকিল দেখা দিলো আরেকটা। বরের কোনো বাড়ি নেই। যে কুঁড়ে- ঘরে গুরায়ারা বাস করতো, সেটা বিক্রি করে দিয়েছে তার বাবা । বাড়ি ছাড়া নতুন কনেকে গুরাপ্পা এখন নিয়ে যায় কোথায় !

শেষমেষ একটা বুদ্ধি খেললো তার মাথায়। টাকা নেই তার, কিন্তু বন দুর্গের কিছু পাথর তো এখনো অবশিষ্ট আছে। অবশ্য ভালো পাথরগুলো চুরি হয়ে গেছে অনেক আগেই, কিন্তু যা আছে, তাতেই কাজ চলে যাবে তার।

চাঁদনী রাতের অপেক্ষায় থাকার  ব্যাপারে ধৈর্যহীন হয়ে গ্রামের মোড়- লের গরুগাড়িটা একদিনের জন্যে চাইলো সে। কিন্তু মোড়ল কি সহজে রাজি হয়। অবশেষে, ফসল কাটার সময় | বিনা মজুরিতে কাজ করে দেয়ার চুক্তিতে গাড়ি পেলো সে।

চুরি করার সময় কোনো সাক্ষী না  রাখাই ভালো—এমনকি গুরাপ্পাও সেটা জানতো। সুতরাং দুপুরের খাবার সেরে রওনা দিলো সে, ফিরে আসবে সূর্য ডোবার আগেই। কিন্তু শাবল দিয়ে একাকী দেয়াল থেকে পাথর খোলা যে কতোখানি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, টের পেলো হাড়ে হাড়ে। গাড়ি পুরো ভরার আগেই পাহাড়ের পেছনে নেমে গেলো সূর্য। কিচিরমিচির শুরু করে দিলো নাইটজারেরা। আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে, ভাবলো গুরাপ্পা। আগামীকাল অন্য কারো গাড়ি নিয়ে আরেকবার পাথর নিয়ে গেলেই হবে।

বাঁশের একটা কঞ্চি নিয়ে হাড়-পাঁজর বের হওয়া গরুটাকে ভীষণ পিটুনি শুরু করে দিলো সে। বাড়ির পথে যেতে যেতে মহাবিরক্ত হয়ে গরুদুটো ভাবলো, কে রে বাবা এই লোকটা, সারাদিন ধরে একবারও দানাপানি দেয়ার নাম পর্যন্ত করে না । গাড়ির পেছন পেছন নিশ্চিন্তে হেঁটে চললো গুরাপ্পা। চারপাশ একে বারে নিঃশব্দ, আতঙ্কিত হবার মতো কিছু নেই কোথাও।

অনেকক্ষণ ধরে তার পিছু নেয়া বাঘটা অনশনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত না হলেও, ভীষণ ক্ষুধার্ত যে ছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। সম্ভবত রোগাক্রান্ত বা আহত হয়ে স্বাভাবিক শিকারে অক্ষম হয়ে পড়েছিল সে। তবে, পুরোপুরি মানুষখেকো অবশ্যই ছিল না। কারণ বেশ কিছুদিনের মধ্যে এ’অঞ্চলে বাঘের হাতে কোন মানুষ মারা পড়েনি।

কান্ডের নিম্নাংশ ল্যান্টানায় হাওয়া একটা বাবলা গাছের পাশ দিয়ে গাড়িটা যেতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঘটা। ল্যান্টানার ঝোপের ভেতরেই লুকিয়ে ছিলো সে। কারণ, ঘটনার ঠিক চব্বিশ ঘন্টা পর একজন ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার, বেশকিছু বনরক্ষী, পুলিশের সাব-ইন্‌সপেক্‌টর ও একজন সেপাইসহ আমি যখন অকুস্থলে পৌঁছলাম, তখনো ল্যান্টানার অনেক লতা মাটির সাথে লেপটে আছে। বিশাল জানোয়ারটা ওখানেই ঘাপটি মেরেছিলো গুরাপ্পার প্রতীক্ষায় ।

সম্ভবত বাঘটা তাকে ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু করার আগ পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারেনি গুরাপ্পা। তারপর বুঝতে পেয়েই ছেড়েছে ত্রাহি চিৎকার। আর, সেই চিৎকারে ভড়কে গিয়ে ভারি গাড়ি সহ গরুদুটো দে দৌড়। কিন্তু খুব বেশি দূর যেতে পারেনি তারা। একটু সামনেই মোড় নিয়ে রাস্তাটা নেমে গেছে ঢালু হয়ে। সেই ঢাল বেয়ে গাড়িসুদ্ধ খাদে পড়ে গেলো দুই গরু।

আশ্চর্যের ব্যাপার, গাড়িটা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গরুদুটো একরকম অক্ষতই রয়ে গেলো। জোয়ালমুক্ত হতেই লেজ তুলে আইয়ুর অভিমুখে ছুটলো।

আইয়ূরের পাশেই বনবিভাগের একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ছাত্রদের সাথে অফি সারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় সেখানে। সিনিয়র কয়েকজন অফিসারসহ একজন রেঞ্জ অফিসার আছেন এই কেন্দ্রের দায়িত্বে। এছাড়া, নার্সারি আর বিভাগীয় দালানগুলোর দেখাশোনার জন্যে আছে কিছুসংখ্যক প্রহরী আর রক্ষী।

গাড়ি ছাড়া গরুদুটোকে ছুটে আসতে দেখে মোড়ল ভাবলো, নিশ্চয় কোনো হাতির আক্রমণে চুরমার হয়ে গেছে গাড়ি। গ্রামের অর্ধেক লোকসহ রেড অফিসারের কাছে গিয়ে বনে একটা অনুসন্ধানী দল পাঠানোর অনুমতি চাইল সে। প্রায় তৎক্ষণাৎ মিললো অনুমুতি, কিন্তু বনে ঢোকার ব্যাপারে গ্রামবাসীদের তেমন উৎসাহ দেখা গেলো না। অবশেষে জনা চার-পাঁচেক লোক রাজি হলো বটে, কিন্তু ততোক্ষণে রাত নেমে এসেছে পুরোপুরি। দিনের বেলাতেই ক্ষ্যাপা হাতির মুখোমুখি হওয়া কঠিন, সেখানে এই নিকষ আঁধারে তো কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং পরদিন সকাল পর্যন্ত মুলতবি রইলো অনুসন্ধান। গাড়ির -চিন্তায় নিশ্চয় সে-রাতে খুব একটা ভালো ঘুম হয়নি মোড়লের, বার বার সে অভিশাপ দিয়েছে সমস্ত নষ্টের মূল গুরাপ্পাকে।

পরদিন ভোরেই শুরু হলো খোঁজ। খাদে পড়া গাড়িটা পাওয়া গেলো সহজেই, কিন্তু গুরাপ্পার কোনো পাত্তা নেই। নরম বালির ওপর পরিষ্কার ফুটে আছে গাড়ির চাকা আর গরুর পায়ের দাগ। গ্রামবাসী ক’জন ভেবে পেলো না এমন কী দেখে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে ছিলো প্রাণী দুটো ?

একটা হাতিই এসবের জন্যে দায়ী ভাবতে ভাবতেই আসল দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলো তারা। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত শুকনো রক্ত, বাঘের পদচিহ্ন আর মানুষ হেঁচড়ে নিয়ে যাবার দাগ পরিষ্কার বলে দিচ্ছে সবকিছু। মুহূর্তের মধ্যে আতঙ্কিত হয়ে উঠলো গোটা দলটাই। ক্ষ্যাপা হাতির মুখোমুখি হওয়া যথেষ্ট ভয়ঙ্কর হলেও এতোগুলো লোক দেখে সে হয়তো ভাববে, কিন্তু মানুষখেকো বাঘ আক্রমণের ব্যাপারে কোনো দ্বিধাই করবে না। সুতরাং কী হবে অযথা খোঁজাখুঁজি করে।

ঘটনাক্রমে, ওইদিনই আমি ছিলাম শিরানী পল্লীতে। ছোট্ট গ্রামটা আইয়ূরের মাইল পাচেক পশ্চিমে। ব্যাঙ্গালোর থেকে পঞ্চাশ মাইলের কিছু বেশি দূরের এই জায়গা। আমার খুবই প্রিয়, উইক- এন্ড এ আমি প্রায়ই ওখানে যাই।

শিবানী পল্লীর বনরক্ষী গিয়েছিল রেঞ্জ অফিসারের সাথে দেখা করতে। সে ফিরে এসে জানালো সমস্ত ঘটনা। একটা টর্চ, একটা সোয়েটার আর দেরি হতে পারে ভেবে পকেট ভর্তি শুকনো বিস্কিট ও এক ফ্লাক্স চা নিয়ে পনেরো মিনিটের মধ্যেই আমি রওনা দিলাম আইয়ুরের উদ্দেশ্যে।

ইতিমধ্যে রেঞ্জ অফিসার মারফত  খবর পৌঁছে গিয়েছিলো আট মাই উত্তরের ছোট্ট শহর দেনকানিকোটা-য় অবস্থিত বন বিভাগের সদর দফতরে। সুতরাং আমি যেতে না যেতেই একজন সেপাইসহ মোটর সাইকেলে করে এসে হাজির হলেন পুলিশের সাব-ইন্‌সপেক্‌টর।  কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের এই দুজন প্রতিনিধি, রেঞ্জ অফিসার ও কয়েকজন বনরক্ষীসহ আমি গিয়ে পৌঁছলাম ঘটনাস্থলে। সাব-ইন্‌সপেক্‌টরটি একজন ব্রাহ্মণ এবং চরম অদৃষ্টবাদী একাধিকবার তিনি বললেন যে, গুরাপ্পার নিয়তিই তাকে টেনে নিয়ে গেছে বন দুর্গের কাছে। তার কথার পুরো অর্থ না বুঝেই রসিকতা করে আমি বললাম, ভাগ্য নিশ্চয় চাইছিলো, মৃত মানুষের জিনিস যে চুরি করে, তাকে শাস্তি দিতে। বিস্মিত হয়ে দেখলাম, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্রাহ্মণ সাব-ইন্‌সপেকটর আর কিঞ্চিত নার্ভাস রেঞ্জ অফিসার, দুজনেই পুরো পুরি সায় দিলেন আমার কথায় । গুরাপ্পার খোঁজ করার ব্যাপারে কারোই কোন ব্যস্ততা নেই।

যাই হোক, একসময় আমরা গিয়ে পৌঁছুলাম সেই ল্যান্টানা ঝোপের কাছে, যার বর্ণনা আগেই দিয়েছি। অস্পষ্ট ভাবে তখনো দেখা যাচ্ছে টেনে নিয়ে যাবার দাগ।

সেই দাগ অনুসরণ করে একশো গজ মতো এগোতেই অপ্রত্যাশিতভাবে শেষ হয়ে গেলো আমাদের অনুসন্ধান কার্য। একটা ‘এরোপ্লেন’ (স্থানীয় তামিলেরা এই নামেই ডাকে) গাছের নিচে লম্বা লম্বা ঘাস। আর, সেই ঘাসের ভেতর থেকেই পাঁচটা আঙ্গুল আকাশের দিকে তুলে বেরিয়ে আছে একটা মানুষের হাত । শেষমেষ আমরা খুঁজে পেলাম গুরাপ্পা কে— অথবা বলা যায়, তার অবশিষ্টাংশ কে।

দেহের ওপরের দিকে, বুক থেকে মাথা পর্যন্ত আস্তই আছে। একটা হাতের আঙুলগুলো আকাশের দিকে তোলা, আরেকটা হাত মুখে ঢোকানো – যেন চিৎকার বন্ধ করতে চায়। চোখের কোটরদুটো শূন্য, ইতিমধ্যেই খেয়ে শেষ করেছে কালো পিঁপড়ের দল । বর্তমানে মুখ আর চামড়া ছেয়ে আছে লাল পিঁপড়ের দল। অনেক জায়গাতেই শেষ হয়েছে চামড়া; লাল পিঁপড়ে খাওয়া নিচ থেকে বেরিয়ে পড়েছে লাল, দগদগে মাংস। শরীরে পচন ধরলেও হায়েনা না শেয়ালের দল কেন এখনো হাজির হয়নি, বোঝা গেলো সহজেই। এই লাল পিঁপড়েগুলোর কামড় খুব একটা আরামদায়ক নয়।

বুকের নিচ থেকে গুরাপ্পার দেহের আর কিছু নেই বললেই চলে। আঁশ মিটিয়ে খেয়েছে বাঘটা, বাকি কাজ সেরেছে বন-ধাঙ্গড়ের দল।

এরোপ্লেন গাছের পাতা শকুনের দৃষ্টি থেকে আড়াল করেছে দেহটাকে, নইলে এতোক্ষণে হাড় ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকতো না।

পচা মাংসের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আছে। ঝাঁকে ঝাঁকে মাছি এসে বসেছে আশপাশের ঘাসে, লাল পিঁপড়েগুলোর জ্বালায় খুব একটা সুবিধে করতে পারছে না। ইতিমধ্যেই বেশ বড়োসড়ো একটা লড়াই হয়ে গেছে দুই দলের মধ্যে। উভয়পক্ষের বেশ কিছু সৈনিকের মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে আর মারাত্মক আহত হয়ে অনেকে চলেছে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে।

এই সামান্য মাংসের জন্যে নিশ্চয় আর ফিরে আসবে না বাঘটা। মৃতদেহ টাকে এভাবে রেখে সে চলে গেলো কেন, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু তার ফলে  লাল পিঁপড়েগুলোর যে মচ্ছবের ব্যবস্থা হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সেপাইকে দেহটা সরানোর নির্দেশ দিলেন সাব-ইন্‌সপেকটর। তারপর অকারণে লিখলেন বিশাল একটা বিবৃতি, যাতে আমাকে আবার সই করতে হলে সাক্ষী হিসেবে। আইয়ুরের রেস্ট হাউসে ফিরতে ফিরতে অন্ধকার নামল চারপাশে। তাঁর ডাকবাংলোতে থেকে যেতে অনুরোধ করলেন রেঞ্জ অফিসার, কিন্তু শিবানীপল্লীতে আমার অপেক্ষায় পড়ে থাকা মাংসের কথা মনে পড়ায় আর রাজি হতে পারলাম না। তাছাড়া, টর্চ আছে সাথে, বাঘটাও পুরোপুরি মানুষ খেকো নয়।

দুই অফিসারের চরম বিরক্তি উৎপাদন করে রওনা দিলাম আমি। পেছন থেকে সাবধান করে দিয়ে তাঁরা বললেন, শিবানীপল্লীতে পৌঁছা আমার ভাগ্যে নাও জুটতে পারে। ল্যান্টানা, গুল্ম আর বাবলার চারার ভেতর দিয়ে চালু হয়ে নেমে গেছে রাস্তা। বেশকিছুটা নামার পর সমতল পাওয়া গেলো।  বড়ো বাঁশের ঝাড় এখানে। অন্ধকার সত্যিই গাঢ় হয়ে এসেছে, তার ভেতর দিয়ে পেন্সিলের মতো সরু হয়ে এগিয়ে চলেছে আমার টর্চের আলো।

হঠাৎ জীবন একটা অস্বস্তি সত্যি বলতে কি, প্রাণভয় পেয়ে বসলো আমাকে। কিন্তু এর কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। কোনো শব্দ বা হরিণ কি অন্য প্রাণীর বিপদসঙ্কেত আমার কানে ধরা পড়েনি। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারদিকে। আমার রাবার-সোলের জুতোর ক্ষীণ মসমস্ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। মাঝেসাঝে শুধু পা পড়ে মচ করে উঠছে একটা পাতা বা পুট করে ভাঙছে কোনো ডাল।

থেমে, ঝট করে পেছন ফিরলাম। প্রায় নিশ্চিত ছিলাম, পেছনেই দঁড়িয়ে আছে বাঘটা। কিন্তু কোথায় কী জোনাকির আলোও চোখে পড়লো না, ডাকে একটা ঝিঁ ঝিঁ।

চকিতে বুঝতে পারলাম আতঙ্কিত হবার কারণ, চরম একাকিত্ব চেপে বসেছে আমার ওপর। আমার কী হলো দেখার জন্যে কেউ নেই কোথাও, কেউ নেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার জন্যে। এবং দেখতে না পেলেও নিশ্চিত জানি, কাছেপিঠেই কোথাও আছে।

জঙ্গলে ভেতরে চূড়ান্ত বিপদের মুহূর্তে মানুষের প্রতিক্রিয়া হয় দু’ রকমের। হাতির চিৎকার বা বাঘ কি চিতাবাঘের গর্জন শুনলে হয় ঝেড়ে দৌড় দেয় সে, নতুবা দাঁড়িয়ে থাকে পাথর হয়ে। চিন্তা শক্তি কাজ করে না বললেই চলে। আসলে, চিন্তা করার সময়ই থাকে না তখন । কিন্তু এখানে কোন হাতির চিৎকার বা বাঘের গর্জন শুনতে পাচ্ছিনা। শুধু বোধ বলছে আশেপাশেই রয়েছে মানুষখেকো। আর আমার ইচ্ছে হচ্ছে ভয়ংকর এই জায়গা থেকে দৌড়ে যতোখানি সম্ভব দুরে চলে যাবার। অতিকষ্টে নিজেকে সামলে রাখলাম। বাঘটাও চাইছে, আমি দৌড় শুরু করি। তাহলেই সে নিশ্চিন্তে আক্রমন করতে পারবে। মানুষখেকো বা অন্য যে কোনো বাঘেই জানে, মানুষ তাদের ভয় পায়। শিকারের হৃদয়ে তারা আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয় পুরোমাত্রায় তারপর আক্রমণ চালায় আস্থার সাথে।

সুতরাং আর যাই করি, দৌড়ানো চলবে না। ওk পেতে আমাকে লক্ষ্য করছে বাঘটা। হয়তো সামনে আছে সে, নয়তো পেছনে অথবা ডান বা বাম- পাশে, সুযোগ খুঁজছে ঝাপিয়ে পড়ার। আমার হাতে টর্চ না থাকলে কাজটা সে সারতো আরো অনেক আগেই। এই আলো তাকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছে। এখন টর্চটা নিভিয়ে দৌড় শুরু করাটাই হবে তাকে আক্রমণে উৎসাহিত করার পক্ষে যথেষ্ট।

দ্রুত চিন্তা চলতে লাগলো মাথায়। সেইসাথে সামনে-পেছনে-দুপাশে উঁকি মারতে মারতে এগিয়ে চললাম মাপা পদক্ষেপে। রাস্তাটা সরু, খুব জোর ছয় ফুট চওড়া হবে ।

আরো কিছুটা এগোতে সামান্য বাঁক নিলো রাস্তাটা একশো গজ মতে৷ সামনে, বামদিকে, ছয় থেকে আট ফুট উঁচু একটা পাথর ধরা পড়লো টর্চের আলোয়। সহজেই ওটার ওপর উঠতে পারবো আমি। চকিতে একটা বুদ্ধি খেলে গেলো মাথায়।

সোজা হাঁটা দিলাম পাথর অভিমুখে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে প্ররোচিত করতে যাচ্ছি বাঘটাকে। কাজটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ- তবু, পাথরটা যখন আর পঞ্চাশ গজ দূরে, মনস্থির করে ফেললাম।

রাইফেলের সেফটি ক্যাচ অফ করে হঠাৎ নিবিয়ে দিলাম টর্চটা, পরমুহূর্তেই প্রাণপণে দৌড় লাগালাম পাথরটার উদ্দেশ্যে। নিবিড় আঁধার নেমে এসেছে চোখের পলকে, দেখতে কিছুই পাচ্ছি না কিছুই। এই জন্যেই দৌড় শুরু করার আগে মনে নিখুঁতভাবে এঁকে নিয়েছি পাথরটার অবস্থান।

শিকার তার ইচ্ছেমতোই কাজ করেছে এটা বুঝতেই কয়েকটা সেকেন্ড ব্যয় করে ফেললো মানুষখেকোটা। এদিকে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি ভাবছি হয়তো কোন বাঘই নেই এখানে;  গোটা ব্যাপারটাই আমার উত্তেজিত স্নায়ুর কল্পনা। ঠিক এইসময় পেছন থেকে ভেসে এলো তীব্র গর্জন। ছুটে আসছে বাঘটা, কিন্তু আমি চেষ্টা করেও গতি বাড়াতে পারলাম না ।

পাথরটার কাছে যখন পৌঁছুলাম, বাঘটা তখন আর মাত্র কয়েক ধাপ পেছনে। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়েই বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঠেলে দিলাম টর্চের সুইচ। লাফ দেয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে, প্রায় পয়েন্ট- ব্ল্যাঙ্ক রেখে, বাঘটাকে লক্ষ্য করে গর্জে উঠলো আমার রাইফেল ।

পেছনদিকে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে গেলো বাঘটা। চোখের পলকে .405 এর আন্ডার লিভার টেনেই আবার টিপে দিলাম ট্রিগার।

কিছুই ঘটলো না ।

একমুহূর্ত পরেই ভীষণ একটা গর্জন ছেড়ে বামদিকে লাফিয়ে পড়লো বাঘটা, অদৃশ্য হয়ে গেলো লম্বা ঘাসের আড়ালে। তাড়াহুড়ো করে গুলি ভরে আবার ফায়ার করলাম ঘাসবন লক্ষ্য করে।

প্রথম গুলিটা করার সময় এতোই আতঙ্কিত ছিলাম যে, শব্দটা প্রায় কানেই আসেনি। কিন্তু দ্বিতীয় গুলিটার প্রচণ্ড শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো এখান থেকে মাইলখানেক দূরের গুলহাট্টি পাহাড়ে ।

বাঘটি আর গজরাচ্ছে না। তাহলে কি আঘাত হেনেছে দ্বিতীয় বুলেট?  নাকি এতোক্ষণে সে মারা গেছে প্রথম বুলেটের আঘাতে অথবা মিস হয়েছে দুটোই? সবচেয়ে খারাপ হবে যদি বাঘটা আহত হয়।

টর্চ জ্বালানো অবস্থাতেই নিজের পর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার জন্য ধপাস করে বসে পড়লাম পাথরটার ওপর। আসলে, এখন আমি ঠাণ্ডা মাথায় গোটা ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখতে চাই। কি বাঁচাটাই না বেঁচে গেছি আজ। আর কয়েক ধাপ সামনে থাকলেই পাথরটার কাছে পৌঁছার আগেই আমাকে ধরে ফেলতো বাঘটা। তাছাড়া, যে গুলিটা ফুটলো না, সেটা ম্যাগাজিনের প্রথমে থাকলে আমার আর রেহাই ছিলো না।

কিছুটা স্থির হতে ভাবলাম, কী হলো মানুষখেকোটার! পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে মিস করবো, এটা কল্পনাই করতে পারি না। কিন্তু উত্তেজনায় বা প্রাণভয়ে যে অবস্থা হয়েছিলো তখন, ট্রিগার টেপার সময় নিশ্চয় মাথার ঠিক ছিলো না। মিস বা আহত করা খুব একটা বিচিত্র ব্যাপার নয়।

এখন, এই গাঢ় অন্ধকারে, বাঘটার পিছু নেয়া অসম্ভব। গুলি মিস হয়ে থাকলে ইতিমধ্যে সে নিশ্চয় পালিয়েছে। আর, যদি আহত হয়ে থাকে, শিবানীপল্লীর উদ্দেশে রওনা দিলে আবার পিছু নেবে- ভাবা যায় না। সুতরাং কয়েক ঘন্টা পর আগামীকাল ভোরেই ওটার পিছু নেবো বলে ঠিক করলাম।

নির্বিঘ্নেই শিবামীপন্নী পৌঁছে শুয়ে পড়লাম আমার ছোট্ট তাবুতে, মাথায় তখনো ঘুরছে আগামীকালের কর্মপন্থা। কিছুক্ষণ পর পকেটের শুকনো বিস্কুট মনে করিয়ে দিলো যে, আমি ক্ষুধার্ত । চা করার জন্যে উঠে বসে খুলে ফেললাম মাংসের টিন, যেটা এই সমস্ত দুর্ভোগের মূল।

সেসময় শিবানী পল্লীতে কোনো পূজারী বা আদিবাসী গাইড না থাকলেও ছিলো মজার লোক শের খান। মুসলমান এই লোকটার বয়স হবে বছর চল্লিশেক । শের খান একজন চোরাশিকারী, কাঠ চোর, এমনকি ডাকাত। যেসব গাড়োয়ান গরুর গাড়িতে করে শস্য নিয়ে যায় দেনকানিকোটা আর অ্যানচেট্টি-তে, সে নাকি তাদের গাড়ি-ডাকাতি করে রাতের বেলায়। সাধারণ হলেও বেশ কার্যকর  তার ডাকাতির পদ্ধতি ৷

সময় বাঁচানোর খাতিরে সাধারনত রাতেই রওনা দেয় শস্যবোঝাই গাড়ী গুলো। বন্যজন্তু, বিশেস করে হাতির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য গোটা ছয়েক গাড়ী যায় একসাথে। বন্য জন্তু ছাড়াও, গাড়োয়ানদের মতে, আঁধার নামার সাথে সাথে নাকি ভুতের মেলা বসে এতদঅঞ্চলে। ডাকাতির প্রথম ঘটনা পুলিশের গোচরে আনে পাঁচজন গাড়োয়ান।

অ্যানচেট্টি থেকে তারা যাচ্ছিলো দেন- কানিকোটায়। গম্ভব্য যখন আর নয় মাইল দুরে, ঠিক সেইসময় ঘটলো ঘটনা । তখন রাত একটা, ঘুমে ঢুলছে প্রত্যেকটা গাড়োয়ান। হঠাৎ রাস্তার পাশের আঁধারের ভেতর থেকে ভেসে এলো জোর, কর্কশ একটা কণ্ঠ। কোনো লোক দেখা গেলো না, কিন্তু কণ্ঠটা বললো, একদল ডাকাত অপেক্ষা করছে মাস্কেট হাতে, কোনোরকম উল্টোপাল্টা করলে গুলি খাবে পাঁচজনই। তবে, নির্দেশমতো কাজ করলে ভয়ের কিছু নেই। এরপর শোনা গেলো নির্দেশ, যা নিতান্তই সহজ সরল ।

“গাড়ি থেকে নেমে পুরো একমাইল হেঁটে যাও পেছনদিকে। দশ নং মাইল- স্টোন পাবার পর বসতে পারো ইচ্ছে করলে। আগুন জ্বালিয়ে ভোর পর্যন্ত ওখানেই থাকবে সবাই। সূর্য ওঠার পর ফিরে আসবে গাড়ির কাছে। মনে রেখো, আমাদের কয়েকজন ভোর পর্যন্ত নজর রাখবে তোমাদের ওপর। নির্দেশ অমান্য করার চেষ্টা চালালে গুলি খাবে সাথে সাথে। মনে রেখো, গাড়ি বা গরুর কোনরকম ক্ষতি করবো না বলে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তোমরা গরিব মানুষ, তোমাদের সাথেও কোন বিরোধ নেই আমাদের। গাড়ীতে করে ধনীদের যে জিনিস বহন করছো, আমাদের লক্ষ্য শুধু ওগুলোই।”

কাঁটায় কাঁটায় নির্দেশ পালন করলো গাড়োয়ানেরা। প্রাণে বাঁচা গেছে, এই পরদিন সকালে তারা ফিরে এলো গাড়ির কাছে। দামী শস্যগুলোই শুধু চুরি হয়েছে, আরগুলো পড়ে আছে যেমনকে তেমন। ডাকাতের দলটা নিশ্চয় খুব বড়ো নয়, ভালো গাড়োয়ানেরা, নইলে তো সব শস্যই নিয়ে যাবার কথা।

দেনকানিকোটা-অ্যানচেট্টির রাস্তায় এরকম ডাকাতি সংঘটিত হলো আরো বহুবার। শেষমেষ রাতে গাড়ি বের করা বন্ধ হয়ে গেলো, রাস্তায় টহল দিতে লাগলো পুলিশ। শের খান ও সন্দেহ ভাজন আরো কয়েকজনকে থানায় বন্ধ করে বেদম পিটুনি লাগালো পুলিশ, কিন্তু অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় শেষপর্যন্ত বাধ্য হলো সবাইকে ছেড়ে দিতে।

এরকম একদফা পিটুনি খেয়ে ফেরার পথেই শের খানের সাথে প্রথম দেখা হয় আমার। ন্যায় জিনিস যে পৃথিবীতে ধীরে ধীরে নাই হয়ে যাচ্ছে, সেকথা চিৎকার করে সবাইকে জানাতে জানাতে ফিরছিলো সে। কিন্তু কপট একটা দুটি খেলা করছিলে তার দুই চোখে।

আগেই বলেছি, সে একজন মুসলমান। তার নামের আক্ষরিক অর্থ ‘বাঘের সর্দার’। দূর্বৃত্ত হলেও মজার লোক হবার কারণে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো তার সাথে। শিবানীপল্লীতে এলেই তার ছোট্ট বাড়ি টাতে গিয়ে একপাত্র চা খেতে কখনোই ভুল করি না। সেও এসে হাজির হয় আমার সাড়া পাবার সাথে সাথে।

সুতরাং পরদিন সকাল হতেই শেরখানের বাড়ি গিয়ে সাহায্য চাইলাম ওর। কেন জানি বার বার মনে হলো, পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি মিস হতে পারে না। জঙ্গলে আহত বাঘের পিছু নিতে গেলে অবশ্যই দুজন যাওয়া দরকার। ঝোপ, পাতা ও  শক্ত পাথুরে জমির ওপর রক্তের চিহ্ন লক্ষ্য করতে গেলে প্রয়োজন চূড়ান্ত মনঃসংযোগ। আর এদিকে নজর রাখতে গিয়ে গাছের গুঁড়ি বা বাঁশবনের আড়ালে আড়ালে চুপিসারে এগিয়ে আসতে পারে বাঘ। আবার বাঘের দিকে নজর রাখতে গেলে হারিয়ে যেতে পারে চিহ্ন। একসাথে নিখুঁতভাবে দুটো কাজ করা একরকম অসম্ভব। সুতরাং দুজন লোক অতি অবশ্য প্রয়োজন। একজন লক্ষ্য রাখবে বাঘের চিহ্ন, আরেকজন লক্ষ্য রাখবে সামনে- পেছনে, দু পাশে। এই দ্বিতীয় লোকের ওপরেই নির্ভর করবে উভয়ের জীবন ।

বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে রাজি হয়ে গেলো শের খান। এবার যথারীতি চা পান পর্ব। হাতে তালি দেয়ার সাথে সাথে সাড়া দিলো তার চার বৌয়ের একজন। সাহেবের জন্যে ‘আচ্ছা চা’ তৈরির হুকুম জারি করলো শের খান।

মুসলমানদের আইন অনুসারে চার বৌ রাখা যায়। আর, এই আইন মান্য করার ব্যাপারে চুল পরিমাণ কার্পণ্য করেনি শের খান। আামাদের পক্ষে একটা বৌ সামলানোই কঠিন, কিন্তু সে চারজন কেই মানিয়ে রাখে অনায়াসে। গোপন পদ্ধতিটা নিম্নরূপ :

চার বৌয়ের কারো প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব দেখায় না শের খান। সবচেয়ে তরুণী বৌ, সবচেয়ে সুন্দরী যা নতুন যাই হোক না কেন। বাইরে যাবার সময় বোরখা পরে যেতে হয় সবাইকে। কাউকেই বৌয়ের মুখ দেখতে দেয় না সে। অবশ্য বিশেষ বন্ধু হিসেবে আমাকে তাদের মুখ দেখা, এমনকি কথা বলারও অনুমতি দিয়েছে।

সাপ্তাহিক কর্মসূচীর ভিত্তিতে গাড়ির কাজ চার বৌয়ের মধ্যে ভাগ করে দেয় সে। কোনো সপ্তাহে এক বৌ হয়তো থাকলো রান্নার দায়িত্বে, আরেকজন তাকে সাহায্য করবে। তৃতীয়জন বাসন- কোসন মাজবে আর চতুর্থজন সারবে টুকিটাকি কাজ যেমন, ঝাড় দেয়া, সেলাই করা, কাপড় কাচা ইত্যাদি। পরের সপ্তাহে বদলে যাবে কর্মসূচী। অর্থাৎ, পালাক্রমে সবার ওপর পড়বে সবরকম কাজের ভার। শের খানের দায়িত্ব শুধু আয় করা—অবশ্য তার কর্মটাকে যদি আয় বলা যায় । যে সপ্তাহে যে বৌটির ওপর থাকবে সবচেয়ে কঠিন কাজের ভার-ধরা যাক, রান্না করা—সেই সপ্তাহে শেরখান তার ঘরে কাটাবে দু রাত, অন্য তিন জনের সাথে এক রাত করে। শুক্রবার ও রোববার হলো ছুটি। শের খানের ভাষায় বিশ্রামের দিন।

গরীব হলেও পরিবারটি সুশৃঙ্খল, সুখী। কখনোই শের খানের সাথে ঝগড়া করে না কোনো বৌ, নিজেদের মধ্যেও ঝগড়া হয় না বললেই চলে। কারণ ঝগড়া করলেই শুরু হবে পিটুনি। এই ব্যাপারেও কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই শের খানের। অপরাধের ধরন বিবেচনা করে গুনে গুনে বাড়ি বা চড় লাগাবে সে। চারটে বৌ থাকলেও কোনো সন্তান নেই শের খানের।

চা খাওয়া শেষ হতেই বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। শের খান বললো, তার কোনো বন্দুক নেই। মরচে ধরা একটা তরোয়াল সাথে নিলো সে। তরোয়ালটা তার দাদার দাদার, যে নাকি মহীশুরের বাঘ টিপু সুলতানের সেনাবাহিনীতে ছিল। তাঁর দাদার দাদা সত্যিই টি সুলতানের সেনাবাহিনীতে ছিলো কি না এটা জানতে গেলে অবশ্য যথেষ্ট হিসেব পাতির দরকার, আমি আর সেদিকে গেলাম না। বরং বাড়ির বাইরে বেরিয়েই আকাশে দিকে মুখ তুলে বললাম:  ”কে যেন অন্ধকারে দাড়িয়ে গাড়োয়ানদের গুলি করার ভয় দেখায়। অথচ তার কোনো বন্দুক নেই। ব্যাপার টা যেন কেমন, তাই না, শের খান ?’

একমুহূর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিলো সে। “সাহেব, ইচ্ছে করলে তুমি আমাকে মিথ্যুক বলতে পারো। কিন্তু আমার সত্যিই কোনো বন্দুক নেই। কখনো ছিলো না। ডাকাত দল বলতে আমি আর আমার তিন বৌ। আরেক বৌয়ের বয়স খুব বেশি। আমাদের সাথে যায় না সে, কিন্তু বুদ্ধি সবই ওই বুড়ির।”

পুরোপুরিই বিশ্বাস করলাম ওর কথা। দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম গন্তব্যের কাছাকাছি। ওই তো সেই পাথরটা, যেখান থেকে গুলি করেছিলাম গত রাতে। তবে, এবার এসেছি এমন ভাবে, পাথরটা পড়েছে ডানপাশে। মাটির দিকে নজর রেখে আমরা এগিয়ে চললাম নীরবে। রক্তের কোনো চিহ্ন নেই কোথাও, অনুসরণ করার পক্ষে মাটিও যথেষ্ট শক্ত। কোনো কথা না বলে আঙুল নির্দেশ করলাম রাস্তার পাশের ঝোপগুলোর দিকে। ওদিক দিয়েই গায়েব হয়ে গেছে বাঘটা ।

মুসলমান বন্ধুটিকে ঠিক পেছনে নিয়ে এগিয়ে চললাম আমি। মাটি খুব শক্ত হলেও, মাত্র কয়েকঘণ্টা আগে খুব ভারি শরীরের কিছু যে চলে গেছে এদিক দিয়েই, তা বোঝা যাচ্ছে। পরিষ্কার পদভারে ভাঙা শেকড়-বাকড় ফুলে আছে এখনো। আরো এক কি দুগজ এগোতেই একসাথে আমাদের উভয়েরই চোখে পড়লো রক্ত।

মাটির ওপরে পড়ে থাকা বাদামী পাতার উপর জ্বল জ্বল করছে লাল লাল ফোঁটা। তর্জনিতে ওটা ঠেকিয়ে ঘষলাম বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে। জমে গেছে। অর্থাৎ, সাধারণ ক্ষত সৃষ্ট হয়নি আমার বুলেটে। ঢুকে গেছে অনেক গভীরে।

সন্দেহজনক সেই ডাল পেরোতেই পাওয়া গেলো একটা ঝোপ। শুকনো রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে ঝোপের নিচের ঘাস। বাঘটা নিশ্চয় এখানে শুয়েছিলো। চারপাশের পাতা ও শেকড়- বাকড় পর্যন্ত মাখামাখি হয়ে আছে রক্তে। জায়গা বদলে শের খানকে সামনে দিলাম। রক্ত চিহ্ন ধরে এগোবে সে, আমি সতর্ক  দৃষ্টি রাখবো চারপাশে।

চিহ্ন অনুসরণ করতে আদিবাসীদের মত নিপুণ নয় শের খান, কিন্তু সেই ঘাটতি টুকু সে পূরণ করে নেয় বুদ্ধি দিয়ে। সামান্য দেরী হলেও রক্তের একটা ফোঁটাও তার চোখ এড়ালো না। লাফালাফি করার কারণে রক্তপাতের পরিমাণ বেশি হয়েছে ধীরে ধীরে। এতে করে অনুসরণের কাজটাও সহজ হল।

সামনে মৃদু একটা নড়াচড়া দেখে স্পর্শ করলাম শের খানকে। তৎক্ষণাৎ থেমে পড়ালো সে। রাইফেল উদ্যত করে এগিয়ে চললাম সেদিকে। নজর রাখছিলাম পেছন দিকেও। বাঘ আহত হলে চালাকির পরিমাণ বেড়ে যায়। সেসময় পেছন থেকে আক্রমণ চালানো বিচিত্র নয়।

আবার শুরু হলো নড়াচড়া। মাত্র কয়েক ফুট সামনে জোরে জোরে আন্দোলিত হচ্ছে ছোট্ট একটা ডাল। খপ, করে শের খানকে ধরে নিয়ে এলাম পেছনে ।

আবার দুলে উঠলো ডাল। তীক্ষ্ণ চোখে খেয়াল করে ঢিল দিলাম শরীরে। ডালটা ভেঙেছে হাতির পায়ের চাপে। এখন মূল গাছের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে দুলছে আপনাআপনি।

এ অবস্থায় কথা বলা একেবারেই চলে না। সুতরাং আবার শের খানকে ধরে নিয়ে এলাম সামনে। ইশারা করলাম এগিয়ে যেতে। সন্দেহজনক সেই ডাল পেরোতে পাওয়া গেল একটা ঝোপ। শুকনো রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে ঝোপের নিচের ঘাস। বাঘটা নিশ্চয় এখানে শুয়েছিল। চারপাশের পাতা ও শেকড়বাকড় পর্যন্ত মাখামাখি হয়ে আছে রক্তে। সম্ভবত বাঘটা থাবা দিয়ে আহত মুখটা ঢেকেছে এখানে। রক্তে মেখে গেছে সারা মুখ। সেই রক্ত আবার ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে।

সামনে মৃদু নড়াচাড়া দেখে স্পর্শ করলাম শের খানকে। তারপর একই জায়গায় পুরো পাঁচমিনিট দাড়িয়ে রইলাম উৎকর্ণ হয়ে । কোনো শব্দ নেই কোথাও। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতার এই রাজ্যে যতো সাবধানেই এগোই, একটু না একটু শব্দ করেইছি আমরা। বাঘটা আশেপাশে থাকলে সে শব্দ নিশ্চয়ই শুনেছে। এ অবস্থায় হয় গর্জন করে তেড়ে আসবে সে, নয়তো কেটে পড়বে চুপিসারে। কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটলো না।

হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে রক্ত-চিহ্নটা বেঁকে গেলো বামদিকে। পাহাড়টার পাদদেশে ছোট্ট একটা স্রোতস্বিনী আছে, সেদিকেই গেছে সে। আঘাত মারাত্মক হলে বুক ফেটে যেতে চায় পিপাসায়। সেই পিপাসা মেটাতে ই ওদিকে যেতে বাধ্য হয়েছে বাঘটা। বছরের এই সময়টাতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু জলাশয় ছাড়া শুকনোই থাকে স্রোতস্বিনীটা। ওই জলাশয়গুলোরই কোনো একটার পাশে আড্ডা গেড়েছে সে। এরপর হয় সুস্থ হয়ে উঠবে, নয়তো অনশনে ধীরে ধীরে বরণ করবে অতি ভয়াবহ মৃত্যু।

কোনো জানোয়ারকে আহত করে যন্ত্রণা দেয়াটা আমার সবচেয়ে অপছন্দ। যেভাবে রক্তপাত হয়েছে, তাতে বাঘটার ভালো হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ভাবলাম, খুঁজে না পেলে কি করুণ অবস্থাই না হবে বেচারির।

কিছুক্ষণ ফিসফিস করে কথা বললাম আমরা। আমি একটা স্রোতস্বিনীর কথা জানি, যেটা আছে এখান থেকে দু’ মাইল দূরে। কিন্তু শের খান বললো, এখান থেকে মাইলখানেকের মধ্যেই আছে। আরেকটা, যেটাতে সারা বছরই পানি থাকে। রক্ত চিহ্ন ধরে এগোতে এগোতে আবার বাঁক নিতে হলো বামপাশে। বাঁক ঘুরতে সামনেই দেখা গেলো ছোট্ট স্রোতস্বিনীটা।

আরেকটু এগোতেই স্রোতস্বিনীর দু তীরে গাছের সারি আর ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে ভেসে এলো বনমুরগির ডাক। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এগোলাম সূর্যালোকে বিবর্ণ ঘাসের ওপর দিয়ে। দেখতে দেখতে ঘাসের স্থান নিলো লম্বা লম্বা সবুজ লতা। গাছের চাঁদোয়া এখানে আড়াল করেছে সূর্যালোক।

স্রোতস্বিনীর তীরের বালির ওপর দিয়ে সোজা চলে গেছে রক্ত-চিহ্ন। মর্মে অনুভব করলাম আহত জানোয়ারটার যন্ত্রণা। গতরাতে বা ভোরের দিকে তীব্র পিপাসা নিয়ে অতিকষ্টে স্রোতস্বিনীর পাশে এসে বেচারি দেখেছে, পানি নেই এখানে ।

কিন্তু ফিস ফিস করে শের খান বললো, পানি আছে। আমি যেটাকে স্রোতস্বিনী ভেবেছি, সেটা ভুল। স্রোতস্বিনীটা আছে বামে। আবার ওকে পেছনে নিয়ে আমি এগোলাম সামনে। অনুসরণ করার আর কোনো অর্থ নেই এখন। কেন জানি মনে হলো, স্রোতস্বিনীর তীরে দেখা যাবেই বাঘটাকে। কিন্তু বাঁক ঘুরেও কোনো জলাশয় চোখে পড়লো না। পেছন থেকে এগিয়ে এসে চ্যাপটা কিছু পাথরের দিকে নির্দেশ করলো শের খান ।

হঠাৎ ওই পাথরগুলোর ওপর থেকেই চিৎকার করে আকাশে উঠলো একটা টিট্টিভ পাখি। জলাশয়টা আছে ঐ পাথরগুলোর আড়ালেই। স্রোতস্বিনীটা সরু হয়ে দুই তীর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। জঙ্গল আর ঝোপঝাড়গুলো হয়ে উঠেছে ভীষন ঘন।

আবার থামলাম আমরা। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারপাশে, বাঘটার পাত্তা নেই কোথাও। নিচের দিকে চেয়ে দেখলাম, রক্তের কোনো চিহ্ন চোখে ধরা পড়লো না। বাঘটা বালির ওপর দিয়ে না গিয়ে তীরের ঝোপঝাড়গুলোর ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে।

এ গানোর পালা শুরু হলো আবার । শেষমেষ ঢাল বেয়ে আমরা গেলাম জলাশয়টার কাছে, যেখানে লেখা রয়েছে বিষন্ন এক গল্প। এখানকার পানি লাল হয়ে আছে রক্তে, চটচট করছে আশপাশের পাথর। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে মাথা টা পানিতে ঠেকিয়ে খানিকক্ষণ শুয়ে থেকেছে বাঘটা। পাথরের ওপর পর পড়ে যাছে রক্তমাখা থাবার দাগ। অবশেষে উঠে সে গিয়ে ঢুকেছে তীরের ঝোপঝাড়গুলোর ভেতরে। ওখানেই পাওয়া যাবে তাকে। আর দশটা বন্য প্রাণীর মতো ওখানেই সে পরম ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করবে মৃত্যুর।

এরপর একটা কথা মনে পড়াতে উধাও হয়ে গেলো সমস্ত আবেগ। বিনা কারণে একজন মানুষকে হত্যা করেছে বাঘটা। | এখন কোনোভাবে ওই ভয়ঙ্কর আঘাতটা কাটিয়ে উঠতে পারলে সে হয়ে উঠবে পুরোদস্তুর মানুষখেকো। তাই, শের খানকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে ইশারা করে আমি এগোলাম বাঘটাকে শেষ করতে।

খানিকটা এগোনোর পর পেছনে একটা শব্দ শুনে ঘুরে দেখি, শের খান আসছে। একা থাকতে হয়তো ভয় লাগছে তার অথবা প্রায় গোটা নাটকটা দেখে শেষ অংক থেকে আর বঞ্চিত হতে চায় না।

প্রায় সাথেসাথেই এতোক্ষণের স্তব্ধতার রাজ্য খান খান হয়ে গেলো প্রচন্ড গর্জনে। ভীষণভাবে আন্দোলিত হয়ে উঠলো ঝোপঝাড়, শক্তিশালী একটা দেহ প্রায় আমার ওপর দিয়ে লাফিয়ে গিয়ে পড়লো শের খানের ওপরে ।

সজোরে মরচে পড়া সেই তরোয়ালটা চালিয়ে দিলো শের খান, ঘ্যাঁচ করে ওটা ঢুকে গেলো বাঘটার পাজরের নিচে। চিৎকার দিতে দিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো শের খান, তার ওপরে বাঘটা। ভাগ্যক্রমে, বাঘটা কামড়ানোর জন্য এগোতেই দু বাহু দিয়ে মুখটা ঢেকেছিলো সে। আমি রাইফেলটা একেবারে ঘাড়ের পেছনে ঠেকিয়ে, বুলেট আমার বন্ধুটিকে আহত করবে না সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে, টেনে হিলাম ট্রিগার।

কাঁপতে কাঁপতে শের খান যখন মুমূর্ষু জানোয়ারটার আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছিলো নিজেকে, গুলি করলাম আরেকবার।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, দু-একটা আঁচড় লাগা ছাড়া আর কোনো ক্ষতিই হয়নি আমার বন্ধুটির। অবশ্য গতরাতের বুলেটও এর জন্যে কাজ দিয়েছে অনেকখানি। বুলেটটা তালু ভেদ করে ঢুকে বেরিয়ে এসেছে নাকের ওপর দিয়ে। চুরমার হয়ে যাওয়া হাড় ঘেঁতলানো মাংসের সাথে একত্রিত হয়ে ঝুলছে। আঘাতটা এতোই বিশ্রী যে, সুস্থ হবার কোনোরকম সম্ভাবনাই ছিলো না বেচারির।

এটা আমার পরম সৌভাগ্য যে, তরোয়ালটা আঘাত হেনেছিলো বাঘকে। তাছাড়া, টিপু সুলতানের সেনাবাহিনীর সেই সৈন্যটির, অর্থাৎ শের খানের পূর্বপুরুষের রক্তপিপাসু তরোয়ালটা আজ হয়তো মানুষের রক্তের স্বাদ পেতো আরেকবার। বাঘ আর আমি ছিলাম একই লাইনে। সুতরাং বাঘটাকে না লাগলে সেই কোপে কচাৎ করে কাটা পড়তো আমার কল্লা।

পরে আমার মুখে এই কথা শুনে হাসলো সে। বললো, আমিও কম যাইনি। মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্যে ওর খুলি উড়ে যায়নি আমার বুলেটে। এরপর সে সবিনয়ে বললো, সংঘর্ষের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বাঘটার চামড়া সে রেখে দিতে পারে কি না। খুশি মনে ওকে দিয়ে দিলাম চামড়াটা। অনেক দোষ থাকলেও অত্যন্ত সাহসী আর মজার লোক সে। সর্বোপরি, চারটে বৌকে মানিয়ে চলার ব্যাপারে এর তুলনা মেলা ভার। যুগ যুগ ধরে ওদের পারস্পরিক সম্পর্ক অটুট থাকুক।

তাঁবুর আগুনের পাশে বসে পাইপ টানতে টানতে শুনছিলাম ওর নানারকম অভিযানের গল্প। আগুন উসকে দেয়ার জন্যে আমরা মাঝে মাঝে গুঁজে দিচ্ছি নতুন কাঠ, স্ফলিঙ্গ লাফিয়ে উঠছে উপর দিকে।

হুক্কা হুয়া! ইয়াহ! ইয়াহ!- শেরখানের কুটিরের পেছন থেকেই ভেসে এলো শেয়ালের ডাক।

তারপরেই ঝপ করে নেমে এলো ভীষন নিস্তব্ধতা। এই নিস্তব্ধতা যেন ছড়িয়ে সমস্ত চরাচরে। এ যেন শোনা যায়, অনুভব করা যায়, জানা যায়। এই ধরনের নিস্তব্ধতাই অপ্রত্যাশিতের আগমন ঘোষণা করে। বনের তাবৎ শব্দাবলীর মাঝে এই নিস্তব্ধতা এতোই আকস্মিকভাবে নামে, যেন কোথাও কোনো সুইচ অফ করে দিলো কেউ। এবারে আরেকটা ডাক ভেসে এলো পাহাড়ের ওদিক থেকে। জঙ্গল ভেদ করে, গাছের সারির মাথা ছুয়ে সেই ডাক ছড়িয়ে পড়লো নিচের উপত্যকায়। অন্য কোন বাঘের গর্জন।

-কেনেথ অ্যান্ডারসন

(অনুবাদ: খসরু চৌধুরী।)

Tags: , , , , , ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!