এক অসামান্য শিকারী- ভ্যান নিয়েকরেক

August 12, 2023

পিয়েটার আর্নেস্ট ক্রুগার ভ্যান নিয়েকরেক, বন্ধুরা ডাকে ‘ভ্যান’ বলে। উত্তর ম্যাটাবেল ল্যাণ্ডের  বিস্তীর্ণ অরণ্যে তিরিশ বছরেরও বেশি সময় কাটান তিনি। এই অরণ্যে গড়ে তোলেন বিশাল র‌্যাঞ্চ। ওয়াংক রিজার্ভের বিস্তৃত জলাভূমি থেকে তাঁর গল্প। | র‌্যাঞ্চে হানা দিতো যতো চিতা, সিংহ আর হাতির দল। এইসব বন্য প্রাণীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি টিকিয়ে রাখেন তাঁর র‌্যাঞ্চ।

বুলাওয়ার উত্তরে এক হোটেল তৈরি করেন ভ্যান। জলপ্রপাতে যাবার পথ যেখানে বাঁ দিকে হঠাৎ বেঁকে গিয়েছে, সেখানে আছে একটা ব্রীজ। সেই ব্রিজের কাছেই তাঁর হোটেলটি। জাম্বেসী নদীর প্রধান উপনদীগুলির একটির ওপর হচ্ছে ব্রিজটি। বন্যার সময় বিশ ফুট ঘোলা পানির নিচে থাকে এই পথ। হোটেল তৈরির যাবতীয় কাজ ভ্যান একাই করেন। ওয়াকি রিজার্ভে ঢোকার রাস্তার কাছে নিজের বাসগৃহও তিনি নিজেই তৈরি করেন। আশেপাশের অনেক জমি পরিষ্কার করে চাষের উপযোগী করে তোলেন। এইসব জমিতে উৎপাদিত ফসলে তাঁর হোটেল ‘ট্রাভেলার্স রেস্ট’ | এর খাবারের প্রয়োজন মিটতো মাংসের প্রয়োজন মিটতো তাঁরই র‌্যাঞ্চের গরু-মোষ থেকে। তাঁর বিশাল র‌্যাঞ্চের অগণিত গবাদি পশুরা বুনো হরিণের সঙ্গে পানি খেতো বিস্তৃত জলাভূমি থেকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের ভিড়ে সব সময় গমগম করতো তাঁর হোটেলটি। তারা দেখতে আসে রিজার্ভ ফরেস্ট, জলপ্রপাত, উত্তর- কঙ্গো, রুয়েঞ্জারী পর্বত আর মুনমাউন্টেন। রোডেসিয়ার বিস্তীর্ণ তৃণভূমির আকর্ষণও কম না।

আরো আসে, খনিজ পদার্থের সন্ধানী, খনিশ্রমিক, মাছির উপদ্রব রোধকারী সরকারী কর্মচারী, ভ্রমণপ্রিয় র‌্যাঞ্চ মালিক আর দুঃসাহসী শিকারীরা। হোটেলের বারে বসে তারা শুনতো ভ্যানের গল্প।

শেষ বয়সেও ভ্যানের চলাফেরায় ছিলো যুবকের ক্ষিপ্রতা। চেহারা দেখে বোঝা যেতো না তাঁর প্রকৃত বয়স। তিনি ছিলেন জাত-শিকারী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কাটিয়েছেন প্রকৃতির কোলে। বুড়ো বয়সেও তাঁকে দেখা গিয়েছে হয় ট্রাকটার চালাচ্ছেন, নয়তো হাতির কিংবা সিংহের পায়ের দাগ অনুসরণ করে মাইলের পর মাইল চলে যাচ্ছেন। বিশ্রামের সময়ও দেখা যায় তাঁর মাউজার বন্দুক আর বুলালা বা সন্ধানী আলোটা প্রস্তুত।

তাঁর বনরাজ্যের পরিবেশটাই ছিলো বলার মতো। হোটেলের দেয়ালে দেয়ালে টাঙানো বিচিত্র সব হরিণের পালিশ করা শিং, অন্ধকারে দেখা যায় এমন সাদা চক্‌চকে দাঁত বের করা চিতার মাথা, অজগরের চামড়া, মেঝেতে বিশাল হাতির গোদা পা, কুমীরের চামড়া যেটার বীভৎস মোটা পেট লেজের দিকে ক্রমশঃ সরু হয়ে গিয়েছে। গোয়াই ব্রিজের নিচ থেকে এই কুমিরটা মেরেছিলেন ভ্যান।

বার-এ ঢুকতেই দেখা যাবে দরজার দু’পাশে পশুরাজ সিংহের বিশাল করোটি। অস্বাভাবিক বড় চিতার সুন্দর ছোপওয়ালা চামড়া, কালো কেশরওয়ালা সিংহের চামড়া আর নানা জাতের হরিণ-চিতার চামড়ায় ‘বার’ কক্ষের দেয়াল ছিলো পূর্ণ। এইসব বস্তু দেখেই ভ্রমণকারীরা বুঝতো কি বিপজ্জনক এই অরণ্যভূমি।

যে যুগে এক জলাশয় থেকে আরেক জলাশয়ের মাঝখানে শত শত মাইলব্যাপী ছাড়া আর কিছু ছিলো না, সেই যুগে তিনি হাজার হাজার মাইল দূরের ক্রেফেন হিলে চালিয়ে নিয়ে যেতেন ট্রেন। মাঝে মাঝে ট্রেন থামিয়ে হরিণ শিকারও করা হতো, যাত্রীরাও যোগ দিতো তাঁর সঙ্গে। সবচেয়ে অসুবিধা হতো জ্যান্ত গরু-মোষ  নিয়ে যাবার সময়। তখনকার দিনে রেফ্রিজারেটর ছিলো না তাই খাবার মাংসের জন্য আস্ত প্রাণীগুলোকেই জ্যান্ত চালান করতে হতো বিশেষভাবে তৈরি ট্রেন-এ। নিরীহ প্রাণীগুলোর গন্ধে রাতের অন্ধকারে ছুটে আসতো সিংহের দল। এঞ্জিনে পানি নেবার জন্য যখন গাড়ি দাঁড়াতো তখন চারিদিক কেঁপে উঠতো পশুরাজের ভয়ংকর গর্জনে আর ভীত কম্পিত পশুদের আর্তনাদে । কোনো জরুরী কাজ পড়লে লণ্ঠন হাতে গাড়ি থেকে নামতে ড্রাইভার আর গার্ডের দরকার হতো অসীম সাহস।

একরাতে ক্যাপ্রি মপোসীতে গাড়িটা চালু করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ভ্যান অপেক্ষা করছিলেন গার্ডের সিগন্যালের জন্য। কিন্তু সময় কেটে যায়, সিগন্যাল আর আসে না। অপেক্ষা করতে করতে অসহিষ্ণু হয়ে নিজের কেবিন থেকে নেমে পড়েন ভ্যান। তারপর লাইনের ধার ধরে পিছনে গার্ডের গাড়ির দিকে হাঁটা ধরেন।

গার্ড হলো লিকলিকে শরীরের স্বল্পভাষী এক স্কট। স্কটল্যাণ্ডের লোকেদের কৃপণ বলে বদনাম আছে। এই লোকটা যেন আরেককাঠি বাড়া, কোথায় কুকুর?” কথাটা পর্যন্ত ব্যয় করতে চায় না। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ভ্যান চেঁচিয়ে ডাক দেন, ম্যাক, এই ম্যাক কোথায় তুমি?’ কোনো সাড়া নেই। আবার হাঁক দেন তিনি, ম্যাক। সাড়া দাও, বাবা। একি ছেলেমানুষী পরিহাস তোমার।”

“আমি এখানে”- করুন সুরে বললো ম্যাক।

অবাক হয়ে ভ্যান বলেন, গাছে গাছে উঠেছো কেন? এখানে তো তেমন কিছুই দেখছি।

তাঁর মন্তব্য শেষ হতেই রাগে ফেটে পড়ে ট গার্ড। এখন আর বাক্যব্যয়ে কার্পণ্য করে না সে। চেঁচিয়ে বলে, না, কিছু নেই। শুধু পাহাড়ের মতো এক সিংহ। গাছ আর লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। বেশি বাহাদুরি না দেখিয়ে ভাগো। মরতে না চাইলে।

ম্যাকের কথা শুনে খুব সাবধানে এঞ্জিনের কাছে পিছিয়ে আসেন ভ্যান। তারপর এক লাফে উঠে পড়েন নিজের কেবিনে। লাইনের ধারের যে গাছটিতে ম্যাক রয়েছে এঞ্জিন চালিয়ে সেখানে নিয়ে আসতে লাগলেন। গাড়ি চালিয়ে আসার সময় সিংহটাকে লক্ষ্য করে জ্বলন্ত কয়লা ছুঁড়তে লাগলেন। চাকার শব্দ শুনে, আর জ্বলন্ত কয়লা গায়ে লাগতে ভড়কে গিয়ে পালিয়ে গেল সিংহ।

আরেকটি সাইডিং-এ একেবারে নতুন এক গার্ড ছিলো। গানম্যানদের সর্দারের বাড়ি ছিলো সে জায়গায়। সর্দারের সঙ্গে ভ্যান গল্প করছিলেন, এই সময় গার্ড লাইন ধরে হেঁটে গিয়ে তার কাজ শেষ করে খুশি মনে শিস দিতে দিতে ফিরে আসে। এসে শোনে এখানটাতে সিংহ আর চিতাবাঘের ভীষণ উৎপাত। গার্ড ভাবে তাকে ভয় দেখাবার জন্যই এরা এসব বলছে। একসময় সে বলে, ‘খুব সুন্দর দু’টো বড় কুকুর দেখলাম তোমাদের এখানে। ছোট ডেন কুকুর বলে মনে হলো। এমন কুকুর এখানে কে পোষে?’ সর্দার অবাক হয়ে বললো, ‘কী কুকুর”

কেন সুইচটা যেখানে”

তাহলে ওরা তো আপনার খুব কাছে ছিলো?

ঠিকমতো দেখেছিলেন?’ জিজ্ঞেস করলো সর্দার। “হ্যাঁ, খুব ভালোমতোই দেখেছি। তবে কোন জাতের কুকুর সেটা সঠিকভাবে বলতে পারবো না। আকৃতি বিশাল। কেন বিশ্বাস করছো না তোমরা?” একটু আহত ভাবেই বললো গার্ড সব শুনে মৃদু হাসলো সর্দার। আর কোনো কথা না বলে সে তার কুটিরের ভেতর থেকে রাইফেল নিয়ে এলো। তারপর ভ্যানকে বললো, লণ্ঠনটা নিয়ে চলুন সুইসের কাছে যাই। আমি বুঝেছি কোন জাতের কুকুর উনি দেখেছেন। আপনিও নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। সুইচ পয়েন্টের কদেক আলো নিয়ে খুঁজলো তারা।

‘এই যে, পায়ের ছাপ) ঠিকই ভেবেছি | আমি। খুব বড় সিংহ আর সিংহী।‘ শুনে বেচারা গার্ডের তো জ্ঞান হরিয়ে ফেলার অবস্থা। অজান্তে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে সে।

বন কেটে বসত বানাতে ভ্যান যখন প্রথম গোয়াইতে এলেন, তখন এই অঞ্চলটা ছিলো একেবারে জনমানবশূন্য। অবশ্য এখনও এ অঞ্চলের আদিম ভয়াবহতা দূর হয়নি। ভ্যান তাঁর জীবনের প্রথম সিংহ মারেন এখানে, তাঁর বসত বানাবার সাথে সাথেই। তাঁর ঘরের কাছ থেকে কুড়ি গজ দূরেও হবে না। সিংহের গন্ধ পেয়ে ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিল তাঁর পোষা কুকুরগুলো। চিৎকার শুনে বারান্দায় বেরুতেই চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পান বিশাল পশুরাজকে। মুহূর্তে চোখাচোখি হয়। হাতের বন্দুক কাঁধে তুলে ট্রিগার টানলেন ভ্যান। বন্দুকের শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই শূন্যে লাফিয়ে সটান মাটিতে পড়ে গেল সিংহটা। এরপর থেকে অসংখ্যবার তাঁকে মোকাবেলা করতে হয়েছে এদের সঙ্গে। তাঁর শিকার করা সিংহের সংখ্যা শ‘য়ের ঘর টপকে গিয়েছে।

একরাতের ঘটনা তাঁর জীবনে অবিস্মরণীয় ঘটনা। যে রাতে তাঁর পশুপালনের বেড়াঘেরা জায়গাটার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল তিনটি সিংহ। স্থানটি ছিলো মেন ফল্স রোড আর গোয়াইয়ের মাঝে। বেড়াঘেরা জায়গাটার মধ্যে ঢুকে সিংহ তিনটি ভয়ঙ্কর গর্জন করতে থাকে। খোলা জায়গা থেকে এই ঘেরা স্থান কিংবা ঝোপের মধ্যে সিংহের অবস্থান বেশি বিপজ্জনক, সব শিকারী আর র‌্যাঞ্চ মালিকরাই জানে। যেখানে নিরাপদ দূরত্ব আর শক্তিশালী রাইফেল ও দূরবীণের সাহায্য পাওয়া যার-তার সঙ্গে এই ব্যাপারটার পার্থক্য অনেক।

সে রাতে ভ্যান যে সাহস আর কৃতিত্ব দেখালেন তা সত্যিই বিস্ময়কর দুঃখের বিষয় তাঁর এই কৃতিত্ব তাঁর কাজের লোকটির ছাড়া আর কারো দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সৌখিন শিকারীদের যেমন সুইচ পয়েন্টের দিকে আলো নিয়ে খুজলো শিকারের ফটো তোলা থাকে, তাঁর তেমনও নেই। কারণ এটা তাঁর শখের শিকার নয়। তাঁর পালিত বিপন্ন পশুগুলোর প্রাণরক্ষার জন্যই তিনি বাধ্য হয়েছিলেন একসঙ্গে তিনটি সিংহের মুখোমুখি হতে। এই ধরনের বিপজ্জনক শিকারে শিকারীর অসীম সাহস, ঠাণ্ডা মাথা, আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ স্থানে প্রাণভয়ে লাফালাফি করা গরু মোষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে এতোগুলো সিংহের মুখোমুখি যুদ্ধে নামা কি যে ভয়ানক ব্যাপার, একটু ভাবলেই তা আন্দাজ করা যায়।

তাঁর পাহারাদার ছুটে এসে খবরটা দিতেই মুহূর্ত মাত্র দ্বিধা না করে প্রস্তুত হলেন যাবার জন্য। কপালে বাঁধলেন আলো, হাতে নিলেন বন্দুক, তাঁর  বিশ্বাসী আফ্রিকান কাজের লোকটির হাতে দিলেন আরেকটি বন্দুক দিয়ে দ্রুত উপস্থিত হলেন সিংহের হানা দেয়া জায়গায়।

পৌঁছে দেখেন একেবারে নরক গুলজার। পাঁচ-ছয় মাইল দূর থেকেও সিংহ ডাকলে মনে হয় একেবারে কানের কাছে ডাকছে। আর এখানটাতে মাত্র তিন/চারশো গজ দূর থেকে এক যোগে ডাকছে তিনটি সিংহ। এতেই বোঝা যায় কি ভয়ানক অবস্থা।

বেড়ার ভিতর ঢুকে পড়লেন ভ্যান। সাহসী ভৃত্যটিও অনুসরণ করলো তাঁকে। শক্তিশালী আলো ফেলে বহু কষ্টের পর দুটিকে খতম করলেন। তৃতীয়টি সিংহী। ভীষণ তার তেজ। আলোকিত স্থান এড়িয়ে চারদিকে ঘুরতে লাগলো ওটা। উত্তেজনায় টানটান ভ্যান ওটার ওপর আলো ফেলে বন্দুকের নিশানার মধ্যে আনার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন।

এই ঘটনা পরবর্তীকালে বলতে গিয়ে কৌতুকচ্ছলে বলেছেন ভ্যান, বুঝলে ভায়া, কিছুতেই সে ধরা দেবে না আমার কাছে। সুন্দরী মেয়ে মানুষের স্বভাবটা তার মধ্যেও ছিলো। তার ওপর অসাধারণ বুদ্ধিমতী। একটি বারের জন্যও যদি সে দাঁড়িয়ে আমাকে একটু দেখতো, তাহলে ধরে ফেলতে পারতাম ক্যামেরার নিশানায়। কিন্তু ধরা সে দিলো না। পালিয়ে বেড়াতে লাগলো।’ রক্ষশ্বাস শ্রোতারা জিজ্ঞেস করলো, এরপর

আপনি কি করলেন?’ ‘ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে আন্দাজে ছুঁড়লাম গুলি। ‘

‘তারপর?’

‘চোখের পলকে বেড়া টপকে পালাতে চাইলো সে। কিন্তু আমার গুলিটা তার গায়ে লেগেছিল। আহত সিংহীর বেড়া ডিঙিয়ে পালানোর পরে মাটিতে রক্তের দাগ দেখে আমি পিছু নেই। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই ফিরে আসি। কারণ, অন্ধকারে আর খুঁজে পেলাম না রক্তের দাগ। পরদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমার কুকুরদের নিয়ে বের হলাম তার সন্ধানে। ওদিকে সেও ছিলো আমার অপেক্ষায়। আমি যে তাকে খুঁজতে আসবো, এটা সে ভালোভাবেই জানতো। তার প্রতীক্ষা আর আমার সন্ধানের হলো শেষ। আমাদের উভয়ের চারিচক্ষের মিলন হতেই তীরবেগে ছুটে এলো সে আমার দিকে। যেন প্রিয়র সঙ্গে পুনর্মিলনের আকাঙ্ক্ষায় উচ্ছ্বসিত প্রিয়া ছুটে আসছে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। দু’জনের মাঝে যখন মাত্র কয়েক গজের ব্যবধান তখনই আমি তার কপালে পরিয়ে সেই রক্তাক্ত গুলির টিপ।’

অন্ধকার রাতে বেড়াঘেরা গরু মোষের খোঁয়াড়ে ঢুকে তিন তিনটা সিংহের মোকাবেলা করতে দুর্দান্ত সাহসী শিকারীও ইতস্ততঃ করবেন। তাই ভ্যানের এই কৃতিত্ব পৃথিবীর শিকারের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ভ্যানের জীবনের সবচেয়ে বড় শিকার যুদ্ধের বেশ কয়েকটি হচ্ছে তথা হাতির সঙ্গে লড়াই। আফ্রিকার বন্য প্রাণীদের মধ্যে এই দৈত্যগুলিই হচ্ছে সবচেয়ে সাংঘাতিক। ছ’টনের হাতিরা চেয়েও বেশি ওজনের বিরাট দেহ নিয়ে ঘন্টায় তিরিশ মাইল বেগে ধেয়ে আসার সময় ওটাকে দেখলে প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসের প্রতিমূর্তি বলেই মনে হয়। সন্ধ্যার আগে হঠাৎ নেমে আসা ঘন কুয়াশার মধ্যে চলন্ত পর্বতসদৃশ এই জানোয়ারকে একবার দেখলে সারাজীবনেও ভোলা যাবে না। কুয়াশার পর্দার মধ্য দিয়ে এই ধীর গতি দানবকে দেখা যায় তার প্রকৃত আকৃতির চেয়ে অনেক বড়।

বেচুয়ানাল্যান্ড আর জাম্বেসী উপত্যকার মধ্যে শুধু ওয়াকি গেম রিজার্ভেই প্রায় দু’হাজারের ওপর হাতি আছে বলে মনে করা হয়। উত্তর ম্যাটাবেলল্যাণ্ডের এই হাতিগুলি সিংহের মতোই ভ্রমণপটু। এরা একরাতেই প্রায় পঁচিশ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। ষাট থেকে একশ পর্যন্ত হাতির এক-একটি দলকে নেতৃত্ব দেয় বিশালাকার বয়োবৃদ্ধ বিচক্ষণ যুথপতি। গোয়াই অঞ্চলে এরকম দু’টি দল একসঙ্গে দেখাটা বিরল কোনো ব্যাপার নয়। দুই দল অবশ্য কখনও এক হয়ে যায় না। একদল যখন পানির কাছে আসে, অন্যদল তখন দূরে সরে থাকে। এইসব হাতির কোনো কোনটা আবার ভ্যানের ফার্মটা ঘুরে দেখার লোভ সামলাতে পারে না।

একদিন সকালে ভ্যান দেখেন তাঁর ক্ষেতের বেড়ার বেশ কয়েক মাইল পর্যন্ত ভেঙে পড়ে আছে। পায়ের ছাপ দেখেই বুঝলেন, দৈত্যাকার প্রাণীটি ধীরে সুস্থে একটির পর একটি করে উপড়ে ফেলেছে লোহার খুটিগুলি। সপ্তাহখানেকের ভিতরেই তিনি দেখা পেলেন এই অনধিকার প্রবেশকারীদের। এই বেআইনী কাজে লিপ্ত শুধু একজন নয়, তিন-তিনজন। তিনজনই বয়ষ্ক পুরুষ হাতি। অবশ্য যুথপতি হবার মতো বয়স কিংবা শক্তি তারা তখনও অর্জন করেনি। ক্ষেতে হানা দেবার উদ্দেশ্যে তিনজনে মিলে দল গড়েছে। এরকম ছোটদল মাঝে মাঝে গড়ে হাতিরা। ক্ষেতের ফসলের স্বাদ যদি একবার পেয়ে যায়। তাহলে সহজে সে স্থান ত্যাগ করতে চায় না; এরপর ওই ফসল যদি আবার কুমড়ো হয়। তাহলে তো কথাই নেই। কুমড়ো খেতে দারুণ পছন করে হাতিরা। বুদ্ধিমান প্রাণী বলে প্রতিরাতেই হানা দেয় না ক্ষেতে। এমন কি ক্ষেতের মালিকে সতর্ক চোখকে ফাঁকি দেবার জন্য অদল বদল করে নেয় হানা দেবার সময়টাও চালাকি করে।  ভ্যানকে হারিয়ে দেবার জন্য কখনো প্রথম রাতে আবার কখনো শেষ রাতে আবির্ভূত হতো ওরা।

যাহোক, একদিন ওদের এই লোভের জন্য ভীষণ মূল্য দিতে হয়েছিল ভ্যানের কাছে। সকাল হয়ে যাবার পরও তারা ক্ষেত ছেড়ে পালায়নি, বরং একাধারে চালিয়ে যেতে থাকে তাদের ধ্বংস- যজ্ঞ। এই অসাবধানতার ফলেই তিনি বাগে পেয়ে গেলেন জানোয়ারগুলোকে।

সকালের স্নিগ্ধ বাতাস হাতিদের দিক থেকে তাঁর দিকে বয়ে আসতে হাতিরা তাঁর গন্ধ পাবার আগেই তিনি হাতিদের গন্ধ পেয়ে যান। এই সুযোগে পৌঁছে যান তিনি ওগুলোর খুব কাছাকাছি। মনের সাধ মিটিয়ে শব্জী খেয়ে তারা আবার অরণ্যের স্বাধীন জীবনে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তার আগেই অনন্ত স্বাধীন জীবনে পৌঁছে গেল বেচারারা।

হাঁটু গেড়ে বসে খুব সাবধানে নিশানা করলেন ভ্যান। .৩৭৫ বোরের রাইফেলের গুলি একটা হাতির গায়ে লাগতেই লুটিয়ে পড়লো ওটা মাটিতে। তার বিশাল জালার মতো পেটটা কাঁটা কোপের ওপর জেগে রইলো শুধু।

বাকি দু’টি হাতি কানগুলো নৌকার পালের মতো আর শুঁড়টা মাস্তুলের মতো উঁচিয়ে ভীষণ রাগে কাঁপতে কাঁপতে কুমড়ো খাওয়া ভর পেট দুলিয়ে  খুঁজে বেড়াতে লাগলো সেই মানুষটিকে, যে খতম করেছে তাদের সঙ্গীকে।

আবার গুলি করলেন ভ্যান। এবার উঠানো শুড়ের তলা দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল একটির মাথা। তার অবশ দেহে মৃত্যুর হীম স্পর্শে শেষ মুহূর্তের কাঁপুনি জাগলো। সামনের পা দুটি গাছের গুড়ির মতো কয়েক মুহূর্ত উঁচু হয়ে থেকে ধপাস করে ভেঙে পড়লো। এরপর চিরদিনের জন্য অনড় হয়ে গেল।

তৃতীয় হাতিটা তীব্রগর্জনে দিগবিদিক  খুঁজে চললো হত্যাকারীকে। শেষ পর্যন্ত তার কুতকুতে চোখ খুঁজে পেলো সেই হত্যাকারীটিকে। রাগে উন্মত্ত হয়ে তীক্ষ্ণ চিৎকারে আকাশ-বাতাস কাপিয়ে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ছুটে এলো শত্রুর দিকে। শিকার আর শিকারীর মাঝখানের ব্যবধান কমে আসতে লাগলো ক্রমেই। অবিচলিত ভ্যান তখনও অপেক্ষায় আছেন। তাঁর চোখের সম্মুখ থেকে মুছে গেল যেন সবকিছু শুধু দেখতে পাচ্ছেন চলন্ত ধূসর এক পাহাড়। সেই পাহাড়ের তলায় নিমজ্জিত হবার আগেই ট্রিগার টিপে একলাফে পাশে সরে দাঁড়ালেন। ট্রিগার টেপার সঙ্গে সঙ্গ মনে হলো যেন প্রচণ্ড বেগে ধাবমান এক্সপ্রেস ট্রেনের এঞ্জিন হঠাৎ লাইনচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ে চুরমার হয়ে গেল।

বনের গাছপালা না খেয়ে মানুষের মেহনতের ফসল চুরি করে খাবার অপরাধে চরম শাস্তি পেলো তিন দস্যু। এইভাবে চরমদন্ড না দিলে তাদের স্পর্ধা বাড়তেই থাকতো। তাতে তারা নির্ভয়ে হানা দিয়ে বেড়াত মানুষের অনেক পরিশ্রমে অন্যানো ফসলের ক্ষেতে। অবশ্য সামান্য চুরির অপরাধে মৃত্যুদণ্ড খুবই চরম শাস্তি। কিন্তু বুনো এই প্রাণীগুলোকে শিক্ষাদানেরও প্রয়োজন আছে। মানুষের কষ্টের ফসল আর তাদের পালিত পশুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে এটা তাদের শেখা উচিত। হাতিগুলোর মৃত্যু কাতর আর্তনাদ, আর বন্দুকের গর্জন অরণ্যবাসীদের কানে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। আর তাতেই অন্য হাতিরা বুঝে গিয়েছিল আসল ঘটনা, কারণ তারা বুদ্ধিমান প্রানী।

গুণ্ডা হাতিদের প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার কথা বলা যাক। একবার এক শিকারীকে ডাকা হলো হানাদার হাতিদের কবল থেকে ফসল রক্ষার জন্য। ওয়াংকি আর বুলাওয়ারের মধ্যে ক্রমাগত হানা দিয়ে বেড়াচ্ছিল হাতির পাল। শহর থেকে চল্লিশ মাইল উত্তরে এই অঞ্চলটি নিয়ামান্দশোলভু নামে পরিচিত। স্থানীয় ভাষায় এর অর্থ নিয়ামা মানে মাংস আর শোলভু মানে হাতি। অর্থাৎ হাতির মাংসের স্থান।

রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে একপাল হাতি ওদিকে গিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছিল। চাষীরা স্থানীয় কমিশনারের কাছে এর প্রতিকার দাবি করলো। ফলে এক শিকারী এসে করলো হাতি নিধনযজ্ঞ। একটি বাদে সবকটাকেই খতম করলো সে। ওই একটাকে সে ইচ্ছে করেই মারলো না। জিজ্ঞেস করে জানা গেল হাতিটা আসলে পালাতে চেয়েছিল তখন। পলায়নপর জানোয়ারকে খুন না করে চলে যেতে দেয়াটাকে সঙ্গত মনে করে ছেড়ে দিয়েছে সে, যাতে অন্য হাতিদেরকে নিজেদের ভাষায় সতর্ক করে দিতে পারে। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই অনেক সময় বন্য প্রাণীরা বিজ্ঞতা লাভ করে।

হাতি অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী। ওদের মধ্যে যেকোনো ভাবেই হোক ভাবের আদান-প্রদান হয়। একজন একটা বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে গেলে অন্যদেরকে সতর্ক করে দেয় যাতে অন্যরা এই বিপদে না পড়ে। ওই ঘটনার পর থেকে সত্যি আর কোনো হাতি হানা দেয়নি।

বন্যজন্তুদের পোষ মানানোর চেষ্টাও ভ্যান মাঝে মাঝে করেছেন। একবার এক বুনো কুকুর পেয়ে পোষ মানান ওটাকে। হলদে, লাল আর কালো রং একত্রে মেশালে যেমন হয় তেমন ওটার গায়ের রং। হায়েনার সঙ্গে ওটার চেহারার দারুণ মিল। আত্মীয়তার সম্পর্ক যে হায়েনার সঙ্গে আছে তা ওটার গায়ের বোঁটকা গন্ধ থেকেই বোঝা যায়। রসিক ভ্যান কুকুরটার গায়ের গন্ধের জন্য ওর নাম দেন ‘ল্যাভেন্ডার‘।

ভ্যানের ইচ্ছা তাঁর পালিত শিকারী কুকুরদের সঙ্গে এই বন্য কুকুরটাকেও যথারীতি শিক্ষিত করে তুলবেন। বন্য কুকুর মেরে তাঁর লেজ দেখালে সরকার থেকে পুরস্কার পাওয়া যায়।

বাঘ-সিংহের চেয়ে আকারে ছোটো হলেও হিংস্রতায় কারো চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এই বুনো কুকুর। বরং অন্য হিংস্র প্রাণীদের চেয়ে এরা আরো বেশি ভয়ঙ্কর, কারণ এরা বড় বড় দল বেঁধে থাকে। এই বুনো কুকুরের দলের সামনে কোনো প্রাণী পড়লে তার আর রক্ষা নেই।

রোভেশিয়া অঞ্চলে এই বুনো কুকুররা সবচেয়ে মারাত্মক। হরিণের পালকে মাইলের পর মাইল তাড়া করে এরা। এরপর কোনো হরিণ ক্লান্ত হয়ে তার গতি সামান্য শ্লথ করলেই কামড়ে ধরে পিছনের পা। রক্তক্ষরণে মুমূর্ষু হয়ে পড়ে গেলে মুহূর্তে সাবাড় করে ওটাকে। তারপর আবার বাকিগুলোর পিছু ধাওয়া করে। পালের প্রতিটি হরিণকে সাবাড় না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হয় না। এই জন্য র‌্যাঞ্চ মালিক আর রিজার্ভ ফরেস্টের লোকেরা এদের সাংঘাতিক ভয় পায়। এতোই ভয়ঙ্কর এরা, দলের কোনো কুকুর আহত হলেও নির্দ্ধিধায় তাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। উমবোক ডুইকার, বাচ্চা কুড়ু, বানর, জেব্রা সবই এদের খাদ্য। এসব প্রাণীর মধ্যে শুধু জেব্রা ছাড়া বাকি সব ধরনের প্রাণীকে গোয়াই থেকে বিলোপ করে দিয়েছে এই বুনো কুকুরের দল। এদের আক্রমণ থেকে জেব্রাদের রক্ষা পাওয়ার প্রধান কারণ হলো জেব্রার দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ আর খুব দ্রুত দৌড়াতে পারে।

এহেন বুনো কুকুরের সদ্যোজাত বংশধরকে উই ঢিবির কাছে পড়ে থাকতে দেখে ভ্যান এর মায়ের অগোচরে একে নিয়ে আসেন। তিনি ভেবেছিলেন, শিকারী কুকুরদের নেতা হিসেবে গড়ে তুলবেন এটাকে। যাতে তাঁর খামারে চিতার উপদ্রব এটি বন্ধ করতে পারে। একমাত্র চিতার আক্রমণেই ভয়ে পালিয়ে আসে তাঁর পালিত কুকুররা।

ল্যাভেন্ডার যতোদিন ছোটো ছিলো ততোদিন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু যেই সে বড় হলো অমনি অন্য কুকুররা তার ত্রিসীমানায় ঘেঁষা বন্ধ করে দিলো। কারণ অন্য কুকুররা কাছে এলে এটি গোঁ গোঁ শুরু করে দিতো। কুকুরদের ভয় দেখানো ছাড়াও ল্যাভেন্ডার হাঁস-মুরগী- টার্কির উপর হানা দেয়া শুরু করলো। ওত পেতে বসে থাকে তারের বেড়ার ধারে। নিরীহ ওই প্রাণীগুলোকে দেখলেই চোখের পলকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের উপর।

ফার্মের পোষা জীবদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর কোন প্রাণী তা জিজ্ঞেস করলে ভ্যান জানান, চিতাবাঘ। এদের মতো শয়তান জানোয়ার আর হয় না। একটা বিশাল আকৃতির চিতা বছরের পর বছর ধরে তাঁর খামারের জীবজন্তুদের মেরে কি যে জ্বালাতন তাঁকে করেছে, সে কাহিনী শোনালেন তিনি। ‘বার’ এর দেয়ালে টাঙানো বিশাল চিতার ছালটা দেখিয়ে বলেন, ওটা ছিলো ভীষণ চতুর।  সাক্ষাৎ ইবলিস।”

একটার পর একটা বাছুর মেরে যাচ্ছিলো ওটা, অথচ কোনো মতেই ওটাকে কায়দা করতে পারছিলেন না ভ্যান। মরা ছাগল-ভেড়ায় বিষ মাখিয়ে চিতা মারার যে সাধারণ নিয়ম তা’ এটির বেলায় একেবারে কাজে লাগেনি। মৃত পশুর ঘাড়ের দিকে বিষ মাখালে সে খেতো পায়ের দিক। পায়ের দিকে মাখালে খেতো ঘাড়ের দিক। ফাঁদ পেতে ধরার চেষ্টাকে যেন সে ব্যঙ্গ ভরেই ব্যর্থ করে দিতো। পেতে রাখা ফাঁদের চারপাশে সতর্কভাবে ঘুরে শেষে টোপের বাইরে বেরিয়ে থাকা অংশে দিতো টান। আর তাতেই অকেজো হয়ে যেতো ফাঁস। তারপর খাবারে পেটটি পূর্ণ করে দিতো চম্পট। কাঁটাঝোপের বেড়া দিয়ে ফাঁদের দিকে যাবার জন্য সরু পথ করে রাখলে সে ওই পথে না গিয়ে বেড়া টপকে চলে যেতো।

এভাবে ক্রমশঃই বেড়ে যেতে লাগলো এটার অত্যাচার, ভ্যান বলেন, বেশি আত্মবিশ্বাসই অবশেষে মৃত্যুর কারণ হয়েছিল ওটার। চিতাটার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির উপযুক্ত জটিল কোনো কিছু না করে, খুব সরল পদ্ধতির বন্দুক-ফাঁদ পাতলেন ভ্যান আর তাতেই কাৎ হলো ধাড়ি শয়তানটা। শিকারের সবরকম পদ্ধতি ব্যর্থ হওয়ায় সবচেয়ে সহজ ফাঁদটি পেতেছেন ত্যান। শুধু একটি বন্দুক, কিছু মাংস আর খানিকটা সরু তার দিয়ে। এই  সাধারণ কিছু জিনিসই বয়ে আনলো ভ্যানের সফলতা আর চিতার চরম দুর্ভাগ্য। খুব বেশি শিক্ষা আর অভিজ্ঞতাই চিতাটার জন্য কাল হয়েছিল। সহজ-সরল এই ফাঁদটাকে অবজ্ঞা করেই মস্ত ভুলটা করেছিল সে।

আরেকটি বড় চিতার গল্প বলেছেন ভ্যান। গোয়াইয়ে র‌্যাঞ্চ মালিকদের ক্ষতি করেছে ওটা। এই চিতাটা ভ্যানের কমবয়সী গরুগুলোকে মেরে  তাঁর ব্যবসায়ে যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি করেছিল। তাঁর  প্রিয় গরুর ভুক্তাবশেষে স্ট্রিকনিন বিষ মাখালেন ভ্যান। বুঝতে পারলেন, রাগের চোটে বিষ মাধানোর পরিমাণ একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে। বিষ জর্জরিত মড়িটা খেয়ে চিতাটা তখনি উগরে দিল যা ছিল পেটে। আর এই জন্যেই বেঁচে গেল ওটা।

এ ব্যাপারটা ঘটার পর ভীষণ সতর্ক হয়ে গেল চিতাটা। কোনো প্রানী মারার পর যতোটা পারে খেয়ে নিয়ে, আবার নতুন শিকারের খোঁজে হানা দিতো। পুরনোটার ধারেকাছে ঘেঁষতো না আর। এ চিতাটার পায়ে সামান্য খুঁত ছিলো, তাই সহজেই একে অন্যদের থেকে আলাদাভাবে চেনা যেতো। শেষ পর্যন্ত, সারা গোয়াইতে এই চিতার পদচিহ্ন বিখ্যাত হয়ে গেল।

নিস্তব্ধ রাতে গোয়াইয়ের ঘন অরণ্যের অন্ধকারে শ্বাপদদের শত শত চক্ষু যখন রহস্যময় তারকার মতো উচ্ছ্বল হয়ে উঠতো, তখন ভ্যানের পান্থশালায় বসে সেই সব প্রাণীদের সম্বন্ধে শোনা যেতো কতো না কাহিনী। শুধু বড় প্রাণীদের নিয়েই ছিলো না সেসব কাহিনী। ছোটো ছোটো প্রাণীদের নিয়েও শোনাতেন তিনি অদ্ভুত সুন্দর সব গল্প। গোপনে বিচরণকারী পিপিলিকা ভুকের ঝলসানো মাংস খেতে খুব পছন্দ করে আফ্রিকার স্থানীয় অধিবাসীরা। বিশাল খামারে ক্ষুদ্র হামলাকারী শজারুর গল্পও শোনাতেন তিনি। একরাতে তার দুটি শিকারী কুকুর শজারুকে তাড়া করতে গিয়ে সারা গায়ে কাঁটা বিধিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় ফিরে আসে। বুশ-পিগ নামে ওই অঞ্চলের একজাতীয় শুয়োর এক রাতেই একটা গোটা সব্জী বাগান ধ্বংস করে দিতে পারে। অন্ধকার রাতে এই শুয়োরের পাল আসার প্রতীক্ষায় ক্ষেতের মধ্যে বসে ভ্যান শুনতেন, বহুদূর থেকে ভেসে আসা সিংহের গর্জন। নদী পাড়ে চিতার হুঙ্কার, আর কাছাকাছি হায়েনার তীক্ষ্ণ হাসি। এক রোমাঞ্চকর রহস্যে ভরে উঠতো রাতের অন্ধকার। এরপর বুনো শুয়োর হামলা করলে নির্ভীকভাবে চালিয়ে যেতেন গুলি।

হাতি-হরিণ-সিংহ-বাইসন – অরণ্যের এ- সব অধিবাসীদের মতো ভ্যানও ছিলেন অরণ্যেরই মানুষ। আফ্রিকার জঙ্গল সম্পর্কে অসাধারণ জ্ঞান ছিলো এই মানুষটির। তাঁর জীবন সঙ্গিনী মিসেস ভ্যানও স্বামীর থেকে কিছু কম নন। বন- কেটে বসত বানানো, তার ওপর ওই ঘন অরণ্যে র‍্যাঞ্চ আর হোটেল চালানো যে কতোটা বিপদ সঙ্কুল তা তিনি ভাল মতোই জানতেন।

বর্ষার পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় যে সব জেলেরা মাছ ধরতে আসতো তারা খুব ভাল মতোই জানতো মিসেস ড্যানের হাতের রান্নার স্বাদ ।

ভ্যান দম্পতি আর নেই। হোটেলের মালিক স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে আর পরিবর্তন করেনি ওই হোটেলের নাম। বর্তমানের বহু পরিবর্তনের মধ্যে আজও টিকে রয়েছে ‘ভ্যান নিয়েকরেক’স হোটেল‘। এই পথে জলপ্রপাত কিংবা রিজার্ভ  ফরেস্টে যাওয়ার সময় পথিককে মনে করিয়ে দেবে ই ভ্যানের কথা। কণ্ঠস্বর চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেলেও এই অঞ্চলে তাঁর স্মৃতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়তো কোনো দিনই হবে না। কারণ ওই মানুষটির জীবন ছিলো অনন্যসাধারণ। (বিদেশী কাহিনী অবলম্বনে)

– ফারহানা নাতাশা

*পূর্বে ‘রহস্যপত্রিকা‘য় প্রকাশিত।

Tags: , , , , ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!