প্রথমেই বলা ভালো, দেশে যতদিন বৈধ শিকারের অনুমতি ছিল ততদিন লাইসেন্স ফি দিয়ে শুধুমাত্র শিকারের মৌসুমে আমিও শিকার করেছি।
সে নিয়মনীতি মেনে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত সভ্য, শিক্ষিত, উন্নত দেশগুলোতে শিকারের বৈধতা এখনো বিদ্যমান আছে এবং থাকবে। বাংলাদেশে ২০১২সালে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণার ভিত্তিতে বৈধ শিকার বন্ধ হওয়ার পর যেটা গভীর ভাবে লক্ষ্য করেছি যে, বন্দুকধারী সৌখিন শিকারীরা প্রায় সবাই দেশের আইন অগত্যা মেনে নিয়ে তারা শিকার বন্ধ করে দিয়েছে বটে কিন্তু এই ফাঁকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিষটোপ/ জাল/ ফাঁদের চোরা শিকারিরা যারা সারাদেশে দিনে শত শত পাখি নির্বিচারে মারছে এবং প্রকাশ্যে/গোপনে বিক্রি করছে। যেটা যেকোনো দেশের বৈধ শিকারের আইনেও সমর্থন করেনা। অথচ ঐসব এলাকার বন্দুকধারী শৌখিন শিকারীরাই এই নির্বিচারে বিষ/জাল/ফাঁদ শিকারীদের সফলভাবে প্রতিনিয়ত বাধা দিয়ে আসছিল পাইকারি হারে প্রানীহত্যা বন্ধ করার জন্য।
বর্তমানে সাধারণ মানুষের কাছে “শিকারি” মানেই অসভ্য নিষ্ঠুর একটা অমানুষ। তাই এখানে প্রকৃত শিকারির বর্ননা দেয়া প্রয়োজন।
প্রতিদিন জাল দিয়ে নদীতে মাছধরা জেলে এবং বছরের নিদৃষ্ট সময়ে নদীতে ছিপ দিয়ে শৌখিন মাছধরা মানুষের মধ্যে যেমন পার্থক্য রয়েছে তেমনি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিষটোপ/কারেন্ট জালে পাইকারি পাখি মারা মানুষ ও বন্দুকধারী শিকারির মধ্যে পার্থক্য আছে। কিন্তু যে বন্দুকধারী পাখির প্রজনন মৌসুমসহ সারা বছর নির্বিচারে পাখি মারে, সে আর যাইহোক সে শিকারি নয় , পোচার।
শুনে হয়তো অবাক হবেন যে ফেসবুকের কথিত শহুরে অন্ধআবেগী পাখিপ্রেমির চেয়ে একজন প্রকৃত শিকারির পাখির প্রতি দরদ বেশি। কারণ একজন প্রকৃত শিকারি কখনোই চায় না তার শিকারের পাখি/প্রানি কখনোও বিলুপ্ত হোক।
তাই বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে হলে আগে জানতে হবে বন্যপ্রাণীর অভ্যাস ও তার প্রয়োজন কি এবং সেটা একজন প্রকৃত শিকারিই সবচেয়ে ভালো জানেন তাই তাদের বাদ দিয়ে এটা রক্ষা করা সম্ভব নয়।
আবেগের বশে গাছে মাটির হাড়ি ঝুলিয়ে পাখির বাসার বিকল্প অসম্ভব ও হাস্যকর। কারণ সব পাখি এতে অভ্যস্ত নয় । পাখির প্রাকৃতিক বাসার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু মাটির হাড়িতে পাখি যদিওবা বাসা বাঁধে এবং সেটা ফুটা করে টাঙ্গালেও ঝোড়ো বাতাসের ঝাঁকুনিতে পাখির ডিম/বাচ্চা হাড়ির দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ডিম ভাঙবে কিংবা বাচ্চা আঘাত পাবে। কারণ দেশের প্রায় সব পাখির প্রজননের সময় বর্ষাকাল।
নদী-বিল শুকিয়ে যেমন মাছ রক্ষা করা সম্ভব নয় তেমনি বন-জঙ্গল উজাড় করে বন্যপ্রাণী রক্ষা করাও সম্ভব নয়।
নির্বিচারে গাছকাটার ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের শিমুল গাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। যে গাছ শামুকখোলের প্রধান আশ্রয়স্থল ছিল। কারন মোটা শক্ত ডালপালার গাছ ছাড়া এই ভারি পাখি বসবাস করতে পারেনা। তাই আজ তারা ঠাঁই নিয়েছে বিভিন্ন লোকালয়ের আমবাগানে। তাতে নষ্ট হচ্ছে মানুষের অর্থ উপার্জনের বাগান। তেমনি বট-পাঁকুড় গাছের বিলুপ্তিতে হরিয়াল খাবার খুঁজে বরই বাগানে। তাই পেষ্ট কন্ট্রোল জালে আটকে পড়ে জীবন হারায় হরিয়াল সহ অসংখ্য অন্যান্য পাখি। বাঁশঝাড়, তেঁতুল, শেউড়া, বাবলা সহ ঘন ডালপালা সমৃদ্ধ গাছ কাটার ফলে উধাও হচ্ছে বক, নিশিবক, পানকৌড়ি সহ বিভিন্ন পাখির আশ্রয় ও প্রজনন ক্ষেত্র। বিলের পাশের খড়বন, চ্যাচড় বন, কলমি, কচুরিপানা উজাড়ের ফলে ধংস হচ্ছে কালিম, কুট, ডাহুক, পাতি পানমুরগি, কোড়া, গুরগুরি, দলপিপি ইত্যাদি পাখির প্রজনন ও আশ্রয়স্থল।
পাতি সরালীর আবাস্থল বরেন্দ্র অঞ্চলের পদ্ম পুকুরগুলোর, পদ্ম, ঘাসদাম বিলুপ্ত হয়ে এখন মাছ চাষের সুইমিংপুল তাই দেশি পাখি সরালির ঝাঁক দিশেহারা হয়ে জাহাঙ্গীর নগরে হাজিরা দিয়ে “অতিথি পাখি” নামে নতুন পরিচিতি লাভ করেছে।
হয়তো বলবেন, মাংস খাওয়ার খায়েশ হলে বাজারের হাঁস-মুরগি খেলেই হয়। অথচ ভাবছেন না বাজারে চাষের মাছ থাকা স্বত্বেও আপনি কিন্তু নদী,বিল, সামুদ্রিক মাছসহ ইলিশ,চিংড়ি, আইড় বোয়াল বাঘাইড় (বাঘাইড় বাংলাদেশের মৎস্য আইন ধরা/মারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ) সহ অসংখ্য প্রজাতির মাছ প্রতি মুহুর্তে আপনার জন্য মারা হচ্ছে আপনি কিনছেনও উচ্চমুল্যে। হালের ক্রেইজ অনেক DSLR ধারি স্বনামধন্য পাখি প্রেমিককে দেখেছি বিলের ধারে পাখি ছবি তুলে কথিত গবেষণার সময় বিলের দুষ্প্রাপ্য মাছ খেয়ে পিকনিক করতে, যেন পরিবেশের ভারসাম্য শুধু পানির উপরিভাগের পাখিতেই সীমাবদ্ধ, পানির নিচে পরিবেশ রক্ষার কোনো জীব নেই। শিকারীর মারা পাখি দেখে হয়তো ভাবছেন পাখিটার বাসায় ডিম/বাচ্চা আছে অথচ বাজারে ডিমভরা ইলিশ, টেংরা কিনে খেতে কিন্তু কোনো অপরাধবোধ/বিবেক কাজ করেনা।
শিকার হলো ছিপ দিয়ে নদীতে মাছ ধরার মতই একটা শখ/খেলা এর কিছু কঠোর নিয়মকানুন আছে সেগুলো মেনে চললে কখনোই কোন প্রজাতি বিলুপ্ত হবে না বরং বৃদ্ধি পাবে। ফেসবুকের পাখি প্রেমিরা বেশিরভাগই এটা জানেনা যে “অতিথি পাখি” বার্ড ফ্ল , এভিয়ান ইনফ্লয়েঞ্জা সহ প্রায় ৬০ ধরনের অসুখ ছড়ায় লোকালয়ের মানুষ সহ গৃহপালিত পশু-পাখির মধ্যে। যার ফলে আমাদের দেশীয় জাতের হাঁসমুরগী, জালালি কবুতর সহ ছাগল,এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে, আমাদের পরিবেশ রক্ষায় সবচেয়ে বেশি যে পাখিটি সোচ্চার তা হলো “কাক” অথচ বিগত বছরে এই বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী সহ অনেক যায়গায় শত-হাজার কাক মারা গিয়েছে নিউজে অনেকেই হয়তো দেখেছেন।
সে কারণেই উন্নত দেশগুলোতে বছরের নির্দৃষ্ট একটা সময়ে নিদৃষ্ট পরিমান পাখি, হরিণ,মাছ শিকারের লাইসেন্স দেয়া হয় এবং সেই লাইসেন্স ফি’র অর্থ (বছরে প্রায় ১.৬বিলিয়ন ডলার) ব্যয় করে সেসব প্রানীর আবাসস্থল ও প্রজননের নিরাপত্তা দেয়া হয় ফলে প্রচুর প্রজাতির পাখি সহ অন্যান্য জীব বিলুপ্তি থেকে বর্তমানে রক্ষা পেয়েছে এবং বংশবৃদ্ধি হয়েছে। এর ছোট্ট একটা উদাহরণ হলো আমাদের দেশের প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরার নীতিমালা ও তার প্রয়োগ, যার ফলে ইলিশের প্রজনন নিশ্চিত হয়েছে ফলে পুরোন দেশের মানুষের ইলিশ খাওয়ার সাধ।
বছরের উপযুক্ত সময়ে, নিদৃষ্ট স্থানে, নিদৃষ্ট প্রজাতির, নিদৃষ্ট পরিমাণ পাখি, হরিন, মাছ শিকারের উচ্চমূল্যে লাইসেন্স প্রদান করে সেই অর্থ ব্যয় করে বনায়ন ও পাখির প্রজনন ক্ষেত্রের রক্ষনাবেক্ষন করলেই শুধু জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব। কারণ জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য ফেসবুকে সাধারণ মানুষ যতই পোষ্ট করুক না কেন , তাদের কেউ শামুকখোলের আবাসস্থল তৈরির জন্য ৫/- টাকাও দিবেনা খাস জমিতে ১০টা শিমুলগাছ লাগানোর জন্য ।
বড় শাস্তির আইন করেও যেমন দেশে চুরি-ডাকাতি বন্ধ করা যায়নি তেমনি শুধু আইন করে অবৈধ প্রানী হত্যাও বন্ধ করা যাবেনা। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, বৈধ শিকারের কঠোর নীতিমালা ও তার প্রয়োগ।
***আপনার দ্বিমুখী অন্ধবিশ্বাসের আবেগ, কখনোই আমার স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের অন্তরায় হতে পারেনা।
এ সংক্রান্ত আলোচনা এই ভিডিও তে দেখতে পারে
1 thought on “বন্য প্রানী সংরক্ষণ/নিরাপত্তা আইন ২০১২ এর ফলে বৈধ শৌখিন শিকারের অধিকার সংক্রান্ত জটিলতা”