জীবনের কাটাকুটি খেলা

September 14, 2019

– আসিফ তাউজ

 

আমি আপনাদের চোখের সামনে দু’টি চিত্র তুলে ধরবো।

খানিকটা ভুল বললাম মনে হয়, চোখের সামনে বলাটা ঠিক হয় নি। গুস্তাফি হয়েছে। বরঞ্চ বলা উচিৎ ছিল মানস্পটে!

যা হোক, চোখ বন্ধ করুন। ভাবুন।

এক জন উঠতি বয়েসী তরুণ। নাম শাফকাত আহমেদ।

শাফকাত আহমেদের আদি নিবাস ছিল কুয়াকাটায়। তবে সে এখন আর কুয়াকাটায় থাকে না। কুয়াকাটায় কাটিয়ে দেয়া শৈশবের দিন গুলো অবশ্য তাকে হঠাৎ হঠাৎ উদাস করে। তবে প্রতিদিন না। ওই যে বললাম- হঠাৎ হঠাৎ!

লেখা পড়া শিখবে, শিখে চাকরি-বাকরি কিছু একটা বাগিয়ে নিবে, তারপর এক দিন লাখ টাকার মালিক হবে, এরকম সদিচ্ছা নিয়ে এক দিন সে পাড়ি জমায় ঢাকার পথে।

অবশ্য এই পাড়ি জমানোর পেছনে লেখা পড়া শেখার লোভের ভূমিকা প্রধান ছিল, নাকি টাকা পয়সা কামানোর লোভটাই মূখ্য বিষয় ছিল সে বিষয়ে আমার ধারণা অতি নগন্য। সুতরাং, জিজ্ঞেস করবেন না।

আজকাল মানুষ আবার লেখাপড়া শিখে চুরি করা জন্যে। রুটি চোরের কপালে ধুম-ধাড়াক্কা পাবলিকের উত্তম মধ্যম জুটতে দেরি হয় না।

 

কিন্তু, হাঁসের পালক দিয়ে গড়া বালিশ, বা খাঁটি স্বর্ণের সুতোয় গড়া পর্দা চোরদের কপালে উত্তম মধ্যম জুটেছে এমন খবর তো শুনি নি।

 

শিক্ষিত চোর হওয়ার সুবিধে আছে বৈকি!

যা বলছিলাম, শাফকাত আহমেদের দৈনন্দিন কর্ম-যজ্ঞের একটা ধারণা দিয়ে নিই!

ইদানিং, তার প্রধান কর্ম হলো উদাস হয়ে বসে থাকা!

এর পেছনেও কারণ আছে।

বছর কয়েক আগে তার হাতে স্মার্টফোন উঠে। স্মার্টফোনের ফেসবুক, ইন্সতাগ্রামে গুতোগুতি করে, লাইক কমেন্ট আর শেয়ারের বণ্যা ভাসিয়ে অবশেষে অনিতা’র ভালবাসা তার কপালে জুটে। তার মনের সিংহাসনে বসে অনিতা।

বেশ সুখী ছিল সে একটা সময়।

তবে সেই সুখ স্থায়ী হয় নি, কারণটাও সহজে অনুমেয়।

ঠিক ধরেছেন।

অনিতার বজ্রাসনের সময়টা-ও ছিল বেশ ক্ষণস্থায়ী!

অনিতার প্রস্থানের পরেই তার জীবনে জায়গা নেয় ধুম্রশলাকা! মানে সিগারেট।

তবে সিগারেটেও তার সাধ বা দুঃখ কোনটাই মেটে নি।

ধীরে ধীরে সিগারেটের জায়গা নিয়ে নেয় গঞ্জিকা! তার জীবনেও, আবার সিগারেটের কাগজের ভেতরেও!

এরপর আরো নানান জিনিসের সমাহার, সেগুলোকে সংক্ষেপে পঞ্চভূত বললে চলে, নাকি পঞ্চপ্রেতাত্মা, তা নিয়ে আমি সন্দেহে ভুগি!

দিনের বেশিরভাগ সময়টায় ইদানিং সে ছাদেই কাটিয়ে দেয়।

ছাদের রেলিং এর কিণারা ধরে হাঁটে, কখনো বা রেলিং এর উপরেই পা ছড়িয়ে বসে।

তার উদাস মুখে কোন অনুভূতির রেখা থাকে না।

শরতের কাশফুলের ন্যায় ধুম্রশলাকার নির্গত ধোঁয়া গুলো-ও কখনো ক্লান্ত হয় না, তার চারিপাশেই থাকে সব সময়টা ধরে।

এবার তার চ্যাপ্টার খতম। তার ব্যাপারে বিশেষ আর কিছু বলার নেই।

 

এবারটায় কথা বলবো সরফরাজ আহমেদ খান- কে নিয়ে।

সরফরাজ সাহেব চাকরি বাকরি কিছু একটা করেন।

শিক্ষা দীক্ষা নিয়েছেন।

তার দীক্ষা- অর্জনের মূল লক্ষ্য কি তা জানি না, আমাদের দেশের শতকরা ১০০ ভাগ ছাত্র ছাত্রী-ই তাদের দীক্ষা অর্জনের মূল লক্ষ্য সম্বন্ধে বিভ্রান্তিতে ভোগে, সরফরাজ সাহেব-ও হয়তো ভুগেছিলেন, তবে সে ব্যাপারে তার সাথে বিস্তারিত আলাপ করি না।

আর আলাপ- আলোচনা বিহীন মন্তব্য করা যে আমার স্বভাব বিরুদ্ধ তা নিশ্চয়ই এতক্ষণে পাঠকের বুঝে যাবার কথা।

 

এই সরফরাজ সাহেবের প্রিয় রঙ বা প্রিয় পোষাক সম্পর্কে আলোচনা করতে পারতাম, তবে তা ঠিক ইন্টারেস্টিং কোন ব্যাপার না।

ইন্টারেস্টিং হচ্ছে সরফরাজের অতীত আর বদলে যাওয়া বর্তমান!

 

একদা সরফরাজ ছিল এন্টি ডিপ্রেসেন্ট জাতীয় ওসুধের হাতে বন্দি এক হতাশ যুবক!

হরহামেশাই তাকে দেখা যেত সিটালোপ্রাম হাইড্রোব্রোমাইড জাতীয় ওসুধ গিলছেন!

ডেসপোটেন নামক কাশির ওসুধটির প্রতি তার ছিল তার চরম মাত্রার ভালবাসা! যদিও তার কফ-শর্দির কোন বালাই ছিল না!

হঠাত হঠাত-ই তাকে দেখা যেতো ক্লোরফেনারামিন বা ক্লোনাজেপাম নিয়ে শান্তির ঘুম দিচ্ছেন তিনি!

আদতে সুখী ছিলেন না মোটেও।

কেন? কিজন্যে এমন-টা ছিলেন?

কারণ নিশ্চিত ছিল ভাই সাহেব, কারণ ছাড়া কেও ডিপ্রেশনে ভোগে না!

সবার অতীত থাকে। সরফরাজ সাহেবের-ও ছিল!

এই সরফরাজ সাহেবিই একদিন ‘দুম করে’ বদলে গেলেন!

রিহ্যাবে গিয়েছিলেন এমন অবশ্য শুনি নি কখনো!

এখন তিনি নিয়মিত অফিস করেন। রাত্রিবেলায় শরীর চর্চা করেন মাঝে মাঝে! কোন কোন দিন দৌড়াতে দেখি তাকে, আবার কোন দিন ছুটেন দ্বিচক্রযান নিয়ে!

মানুষ বদলায়! সেই বদলানোর পেছনে কারণ-ও থাকে!

অনেক ভেবে চিনতে একদিন তাকে চট করে কারণ-টাই জিজ্ঞেস করে ফেললাম!

সেই কথোপকথনের একটি ক্ষুদ্রাংশ  শুধু তুলে ধরলাম। এই একটি বাক্যই আমার লেখার মূল ভাব প্রকাশের জন্যে যথেষ্ট। আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি যা বলেছিলে, তা খানিকটা এই রকম –

” বুঝলেন ভাই সাহেব, একটা সময়ে বেশ ঘুমিয়ে থাকতাম। দুঃখ দুর্দশায় ভরা একটা পৃথিবী, মনে হতো ঘুমিয়ে থাকলেই বুঝি দুঃখ কেটে যাবে, ভুলে থাকা আর কি এক ধরণের!

সেবারটায় বেড়াতে যাই বন্ধুদের সাথে, ছেড়া দ্বীপে। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের একেবারে শেষ বিন্দু, জানেন বোধহয়।  সেখানটায় একটা রাত কাটাই। সে রাতটাই জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দেয়!”- এক নাগারে বেশ কিছু কথা বলে খানিকটা দম নেন সরফরাজ সাহেব।

কিন্তু, এই অল্প কথায় তো কৌতূহল মেটে না। আবার প্রশ্ন করি তাকে।

” ব্যাপারটা খোলাসা করুন তো ভাই!”

” সে রাতটায় এক বন্ধু দ্বীপের মাঝেই টেলিস্কোপ সেট করে। সারা রাত আমি বুভুক্ষের মতো শুধু আকাশ-ই দেখি ভাই সাহেব। পৃথিবীতে তে বসেই এতো সুন্দর দৃশ্য দেখা সম্ভব তা আমার কল্পনায় ছিল না। ছেড়া দ্বীপের আকাশ কিন্তু বেশ পরিষ্কার বুঝেছেন? আমাদের এই শহরতলীর মতো নয়। ”

“তাই নাকি?!”

” হ্যাঁ সত্যিই। সে রাতটায় বন্ধুবান্ধব ঘুমিয়ে পড়লেও আমি সেই টেলিস্কোপ নিয়েই পড়ে ছিলাম। কি দেখেছি জানি না, তখনটায় অতো নক্ষত্র ফক্ষত্র বা তারা, কিছুই চিনতাম না। বন্ধু শুধু দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে ফোকাস করতে হয়। তাতেই কাজ হয়েছিল। অনেক দিনের উপোষী ছিলুম তো, প্রকৃত  সৌন্দর্য কি তার সম্পর্কে চোখ দুটোর কোন ধারণা ছিল না। গোটা রাতটায় শুধু দেখেই গেলাম… দেখেই গেলাম…!”

” চমৎকার, তারপর? ”

” তারপর এই আর কি। নিজেকে আস্তে আস্তে বদলে ফেললাম। এতো সুন্দর এই পৃথিবী দিয়েছেন স্রষ্টা। সেটা কি দু চোখ ভরে না দেখলে পাপ হবে না?”

” হবে বৈকি। অবশ্যই হবে। আল্লাহর সৃষ্টি-কে হেয় করার নূন্যতম অধিকার আমাদের নেই।”

“সেটাই ভাইসাহেব। আর এই সৌন্দর্য দর্শন থেকে নিজেকে বিরত রাখাটা অনেকটা হেয় করারিই মতো।”

“সত্যিই”- আবারো একমত হলাম তার সাথে।

” এরপরে ঢাকায় ফিরেই একটা টেলিস্কোপ কিনে নিয়েছি। দেশীয় হ্যান্ডমেইড জিনিস। বেশ সস্তায় পাওয়া যায় ইদানিং। কিন্তু, দারুন কার্যকরী! ”

“চমৎকার ভাই! তা এখন কেমন আছেন?”

” স্বচক্ষে দেখেও প্রশ্ন! কোন কোন বিকেলে এয়ার গান হাতে নেই, টার্গেট প্র‍্যাকটিস করি। কোন দিন তীর ধনুক নিই, আর্চারি যাকে বলে। ওসব দিয়েও দারুন টার্গেট প্র‍্যাকটিস করা যায়! আবার কোন কোন বিকেলে হই হল্লা করে সিনেমা দেখে আসি। কখনো বই পত্র পড়েই সময় কাটিয়ে দেই…..”

” বলেন কি ভাই সাহেব? এসব তো কল্পনাতেও ছিল না! ”

” জানি রে ভাই। আমাদের বেশির ভাগ মানুষ উপভোগ করার উপায়টাই জানে না! তাই তো শহরজুড়ে এতো দুঃখ। এতো হতাশা! ”

” খারাপ বলেন নি। চাকরি বাকরি..”

” ওটা শখের বসে করছি না ভাই সাহেব” মুখের কথা কেড়ে নিয়েই জবাব দেন, ” টাকা পয়সা জমিয়ে পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখার ইচ্ছে। মাঝে বউ- বাচ্চা হয়ে গেল ভালোই হবে। তাদের-ও এই ব্যাপারে দীক্ষা দিতে হবে”- কথাটা শেষ করেই বেশ জোরে অট্টহাসি দিলেন ভদ্রলোক। বুঝি বেশ আনন্দের কথা বলেছেন।

আমি চুপচাপ বিদায় নিয়ে আমার গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম। মনে মনে বললাম, ” এমন দীক্ষাগুরুর-ও বোধহয় প্রয়োজন আছে!”

সরফরাজ বা শাফকাত দু’জনেই মানুষ। তবে তারা একই রকম মানুষ নন।

সমাজ বা ব্যক্তি বিশেষ বা নিজেকে বদলানোর পূর্বে মনে হয় চিন্তাভাবনার ধরণটা পালটানো দরকার।

তাই না?

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!